চিত্রশিল্পে যৌথ একাকিত্ব উদযাপন
দেহ আর ধারণার বন্ধন হলো, অন্তর্গত রূপকে যা প্রকাশ করে এবং যা আড়াল করে।
—মরিস মার্লো পঁতি
মহামারি মানুষকে দুটো বিষয়ের মুখোমুখি করেছে। প্রথমত মানব অস্তিত্বের সংকট, দ্বিতীয়ত প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কেউ অধরা নয়। ফলে অনির্বচনীয় মৃত্যুকে সহজে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে মানুষ। কিন্তু মহামারির বিপরীতে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাসও বর্তমান। ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ পল সার্ত্র কথাটা এভাবে বলেছেন—মানুষের জীবন কিছুই না, যতক্ষণ সে যাপন না করে। সার্ত্রের কথায় স্পষ্ট, মনুষ্য জীবনের প্রধান সংকট যাপনের সমস্যা। তাঁর মত—অস্তিত্ব আগে, তারপর নিয়মের নির্যাস। আমরা সার্ত্রের কথা একটু ঘুরিয়ে বলব—যাপনের আগেও মানুষের জীবন থাকে আর যাপন মানুষের অস্তিত্বকে জানান দেয়। কিন্তু মহামারি প্রকৃতির নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায়। ফলে মানব অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখিন হয়। আর সংকট মানুষের ভেতরে নতুন ধারণা ও নতুন সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে। শিল্পী মোস্তফা জামানও এমন ইশারা করেছেন, ‘দুনিয়াদারি যে নতুন করে দেখবার ও যাচাই করবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, সময় যে কেবলই অন্তিমের কিছু আলামত তুলে ধরছে, সন্ধি বিচ্ছেদ সেই গল্পের সূত্র ধরে গড়ে উঠেছে।’ আমরা দেখব শিল্পকলার ক্ষেত্রে কিভাবে সেটা কাজ করে।
তর্ক বাংলা আয়োজন করেছে বর্তমান সময়ের অনন্য চিত্রশিল্পী মোস্তফা জামানের একক প্রদর্শনী। তাঁর প্রদর্শনীর শিরোনাম সন্ধি বিচ্ছেদ। বাংলাশাস্ত্র মতে, সন্ধি মানে সন্নিহিত দুটো ধ্বনি বা স্বরের মিলন। আর শব্দের সন্নিহিত স্বর থেকে স্বর বা ধ্বনি থেকে ধ্বনি আলাদা হলে বলা হয় সন্ধি বিচ্ছেদ। কিন্তু বাংলাশাস্ত্রের সন্ধি বিচ্ছেদ আর মোস্তফা জামানের শিল্পের সন্ধি বিচ্ছেদ এক নয়। নামে এক হলেও তাতে শব্দের ভাবার্থ আর দৈহিক রেখার তফাৎ বিস্তর। তাঁর সন্ধি বিচ্ছেদ নিছক ভাষার কোশেশ নয়, মানব ইন্দ্রিয় উদযাপিত শিল্পের সংবেদনশীল বিরহের রূপ। কেননা বিচ্ছেদ মানে মিলন নয়, বস্তুর ভিন্ন প্রকৃতির বিশেষ আকার। স্থিত বস্তুর সঙ্গে সঙ্গতিহীন—যা বিচ্ছিন্ন অপর রূপ কিংবা বলা যায় বস্তুর খণ্ড খণ্ড ভিন্ন রূপ। এই রূপ প্রকৃতি নির্ধারিত কাঠামোগত বিন্যাস নয়, বরং তার বিপরীতে নব রূপান্তরের আবেগপূর্ণ প্রতিক্রিয়া। মোস্তফা মূলত দেহকে বিচ্ছেদি ভাষার শৈল্পিক আকার দিয়েছেন। সেটা কেমন?
মহামারির বিচ্ছিন্নতা আধুনিক বিচ্ছিন্নতা থেকে ভিন্ন। আধুনিক বিচ্ছিন্নতার প্রধান কারণ ব্যক্তিকে বস্তুর উপযোগ হতে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে বস্তুর ফল ব্যক্তির নাগালের বাইরে বাইরে থাকে। ব্যক্তির এই একাকিত্ব বস্তুরই একাকিত্ব। মানে বস্তু বিযুক্ততার একাকিত্ব। কিন্তু মহামারি শুধু ব্যক্তি নয়, সামষ্টিকের টিকে থাকা না থাকার প্রশ্ন সামনে আনে। বস্তুত সময়হীনতার খোপে মানুষ একা হয়ে যায়। বলা যায় যৌথ একাকিত্বের ডোরে মানবের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। মোস্তফা জামান শিল্পকর্মে সেই যৌথ একাকিত্বকে চিহ্নিত করতে চান। তাঁর সন্ধি বিচ্ছেদ শিল্পকর্মে মূর্ত অস্তিত্বের যে সংকট, সেই সংকটের দৃশ্যাবলিই হাজির। তিনি শিল্পকে উদ্দিষ্ট করেন—নিছক ব্যক্তির অবয়ব চর্চা নয়, সামষ্টিক অবয়বের অপূর্ব কৃৎকৌশল রূপে। কেননা মানুষের যৌথ একাকিত্ব সর্বদা প্রকৃতি নির্ভর। আর এই সংবেদনশীল জায়মান অবস্থা মোস্তফার শিল্পকর্মে মানব শরীরের বৈসাদৃশ্য তরঙ্গে রেখাপাত করেছে। আমরা তাঁর শিল্পকর্মের কয়েকটি প্রসঙ্গ সামনে আনব।
নন্দনতাত্ত্বিক দিক থেকে মোস্তফা তাঁর শিল্পকর্মকে সময়হীনতার কাছে ছেড়ে দিয়েছেন। অর্ধ আকৃতি কিংবা অর্ধ বিকৃতির এই মানব অবয়ব এমন শূন্যতা সৃষ্টি করে—দেহ যেন অতীতের অনুপস্থিতির স্মারক। মানব চরিত্রাবলী এমন অদ্ভুত শারীরিয় খেলায় রত, যা পরিবর্তনশীল সমাজ রূপান্তরের চিহ্ন আকারে বলবৎ থাকে। তিনি সরল সংবেদনা থেকে জটিল জটিল আধ্যাত্ম লীলায় প্রবেশ করেন। এমন কি—মানব অবয়বের উপর ছোপ ছোপ রঙের ব্যবহার রহস্যময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
প্রথমত, মোস্তফা জামান শিল্পকর্মে রূপান্তর প্রক্রিয়া কিভাবে ঘটান? বস্তুত যে কোনো শিল্পের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বহিরাবরণ আর অভ্যন্তর রূপান্তরের সম্পর্ক। কাঠামোগত রূপ বিবেচনা করলে প্রকৃতি মাত্র শিল্প নয়, শিল্প সেই অবয়ব যা প্রকৃতির নববিন্যাস কিংবা নবরূপান্তরের আবেগপূর্ণ প্রতিক্রিয়া। রূপান্তরের এই প্রক্রিয়া তিনভাবে সংগঠিত হতে পারে—ভাবগত, অভাবগত আর বস্তুগত। শিল্পের ভাবগত রূপ হলো নিরাকারের সাধনা। মানে নিরাকার রূপের আলোক দান। কখনো কখনো এই ভাবগত রূপ বস্তুগত আকারের নিরাকার করণ করে। আর অভাবগত রূপ হলো বস্তু কিংবা অবয়বের আকারগত অনুপস্থিতি। মানে অবয়বগতভাবে যা আছে, তার স্থিতির অভাব। আর বস্তুগত রূপ হলো শিল্পে অবয়ব কিংবা প্রকৃতির আকার দান। এই আকার মূর্ত বা বিমূর্ত দুই হতে পারে। তিনটি দিক বিবেচনায় আনলে মোস্তফার শিল্পকর্মের অন্তর্গত রূপ আমরা পরখ করতে পারব।
দ্বিতীয়ত, মোস্তফা জামান শিল্পকর্মে মানব দেহকে কিভাবে উপস্থাপন করেন? তাঁর ক্যানভাসে দেখা যায় দেহের প্রকৃতি বিমূর্ত, কিন্তু দেহাবয়ব বিমূর্ত নয়। গতিময় রেখা দেহের আকারকে স্পষ্ট করে তুলেছে। ছিন্ন-ভিন্ন দেহাবয়ব এমন—কোনো কোনো ক্যানভাসে শরীর থেকে হাত-পা বিচ্ছিন্ন, কোথাও কোথাও অর্ধ মস্তকের সমাহার, কোথাও কোথাও দেহের অঙ্গ সন্ধি আলাদা হয়ে আছে, কোথাও কোথাও ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির টুকরো টুকরো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নানা ঘটনায় লিপ্ত, কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্ন অঙ্গের ফাঁকে বৃত্তাকার শূন্য। ফলে দর্শকের দিক থেকে এমন দৃশ্যকল্প এক ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করে। তবে ক্যানভাসের কোথাও দেহের ভঙ্গি স্থির নয়। শিল্পকর্মে উপস্থাপিত নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নানা কসরতে লিপ্ত। তবে ক্যানভাসের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সন্ধিচ্যুত হলেও কাঠামোগত ভর বিন্দু বৈসাদৃশ্য নয়, বরং যুৎসই কাঠামোর উপর খাড়া। এমন কি—দেহের ভর বিন্দুর সঙ্গে নানা প্রজাতির পশু-প্রাণী-পাকপাখালির উপস্থাপিত ঘটনাও সাদৃশ্যপূর্ণ। এমন সাদৃশ্যপূর্ণ প্রকরণ তাঁর শিল্পকে পরিণত আকার দিয়েছে।
সন্ধি বিচ্ছেদ নিছক ভাষার কোশেশ নয়, মানব ইন্দ্রিয় উদযাপিত শিল্পের সংবেদনশীল বিরহের রূপ। কেননা বিচ্ছেদ মানে মিলন নয়, বস্তুর ভিন্ন প্রকৃতির বিশেষ আকার। স্থিত বস্তুর সঙ্গে সঙ্গতিহীন—যা বিচ্ছিন্ন অপর রূপ কিংবা বলা যায় বস্তুর খণ্ড খণ্ড ভিন্ন রূপ। এই রূপ প্রকৃতি নির্ধারিত কাঠামোগত বিন্যাস নয়, বরং তার বিপরীতে নব রূপান্তরের আবেগপূর্ণ প্রতিক্রিয়া...
তৃতীয়ত, যে কোনো শারীরিক শিল্প লৈঙ্গিক আর আত্মপরিচয়ের বিষয়াবলীর সঙ্গে যুক্ত। গেল শতাব্দির ষাটের দশকে মার্কিন মুল্লুকে দেহবৃত্তীয় শিল্পের পসার ঘটে বেশ। ব্যাপক হারে সে সময় মানব দেহ হয়ে ওঠে শৈল্পিক ক্যানভাস। শরীরকে ভাষার বাহন আকারে হাজির করা হয়। সামনে আসে শিল্প-দর্শনের দুটো বিষয়—লৈঙ্গিক ভেদ বিচার আর আত্মপরিচয়ের রাজনীতি। প্রথমত, দেহ হচ্ছে নারী আর পুরুষের মধ্যে সবচে দৃশ্যমান ফারাক। অন্যদিকে আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে ‘বর্ণবাদী’ ও ‘যৌনতাবাদী’ মতাদর্শের ভিত্তির সন্ধান। এমন তত্ত্বায়নের সংকট হলো—শিল্পে নিছক নারীর প্রকৃতি ও সত্তার সন্ধান দৃষ্টিভঙ্গিগত ভাবে একরৈখিক। যার ফলে বর্ণবাদ আর যৌনতাবাদের বিপরীতে মুক্ত মানববাদ অনিরাপদই থেকে যায়। সেই ক্ষেত্রে মোস্তফা জামানের শিল্পকর্ম কিছুটা দূরে অবস্থান করে। বস্তুত তাঁর শিল্পকর্ম যৌথ একাকিত্বের সংবেদনশীল রাজনীতি হাজির করে। ভেদাভেদ ভিন্ন, তাঁর ক্যানভাসে নারী-পুরুষ সম্মিলিত ক্রিয়া করে। অস্তিত্বের সংকটাপন্ন মানব চরিত্র কিছুটা আদিম পরিচ্ছদহীন।
নন্দনতাত্ত্বিক দিক থেকে মোস্তফা তাঁর শিল্পকর্মকে সময়হীনতার কাছে ছেড়ে দিয়েছেন। অর্ধ আকৃতি কিংবা অর্ধ বিকৃতির এই মানব অবয়ব এমন শূন্যতা সৃষ্টি করে—দেহ যেন অতীতের অনুপস্থিতির স্মারক। মানব চরিত্রাবলী ক্যানভাসে এমন অদ্ভুত শারীরিয় খেলায় রত, যা পরিবর্তনশীল সমাজ রূপান্তরের চিহ্ন আকারে বলবৎ থাকে। তিনি সরল সংবেদনা থেকে জটিল জটিল আধ্যাত্ম লীলায় প্রবেশ করেন। এমন কি—মানব অবয়বের উপর ছোপ ছোপ রঙের ব্যবহার রহস্যময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। মনে হতে পারে শিল্পে প্রচলিত সেই বিখ্যাত উক্তি—শিল্পের রহস্য হলো প্রচলিত ছকের বিন্যাসকে নস্যাৎ করে দেওয়া। শিল্প সেখানে রহস্যময় নতুন আকার পায়। মোস্তফা শিল্পের সেই পথেই এগিয়েছেন। বস্তুত মহামারি মানুষকে নির্মল-নির্মম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ধারণার শৈল্পিক রূপ এই প্রদর্শনী। প্রিয় দর্শক ও পাঠক, তর্ক বাংলায় উপস্থাপিত শিল্পকর্ম তাঁর ষষ্ঠ একক প্রদর্শনী। তর্ক বাংলারও এটি ষষ্ঠ আয়োজন। আমাদের প্রত্যশা—মোস্তফা জামানের শিল্পকর্ম সন্ধি বিচ্ছেদ নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করবে আপনাকে। কেননা সুন্দর সর্বদা সময়হীন। একই সঙ্গে অন্তর্গত রূপ খোলা এবং রহস্যময়।
তত্ত্বতালাশ
১. Maurice Merleau-Ponty, Phenomenology of Perception [New York, London: Routledge, 1962]
২. Jean-Paul Sartre, Existentialism and Humanism, translated by Philip Mairet [London: Methuen Publishing Ltd, 2007]