চিত্রশিল্পী। প্রকৃত নাম আবু শরাফ মোহাম্মদ কামরুল হাসান। ১৯২১ সালের ২ ডিসেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার নারেঙ্গা গ্রামে। কামরুল হাসানের শিক্ষাজীবন কাটে কলকাতায়। তিনি কলকাতার মডেল এম ই স্কুল [১৯৩০-৩৫] এবং কলকাতা মাদ্রাসায় [১৯৩৬-৩৭] প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস-এ ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে চিত্রকলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবনে চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি তিনি বয়েজ-স্কাউট, শরীরচর্চা, শিশু সংগঠন মণিমেলা, মুকুল ফৌজ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৫ সালে শরীরচর্চা প্রতিযোগিতায় তিনি বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হন। দেশবিভাগের পর কামরুল হাসান ঢাকা চলে আসেন। সে সময় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে মিলিত হয়ে ঢাকায় একটি আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন [১৯৪৮]। ঢাকায় চিত্রকলার চর্চা ও প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৫০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আর্ট গ্রুপ। ১৯৬০ সালে তিনি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশনের নকশা কেন্দ্রের প্রধান নকশাবিদ নিযুক্ত হন। ১৯৭৮ সালে ওই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কামরুল হাসান বাংলাদেশের স্বাধিকার ও অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন [১৯৬৯-৭০] এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার দপ্তরের শিল্প বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। এ সময় পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের রক্তপায়ী, হিংস্র মুখমণ্ডল সম্বলিত একটি পোস্টার এঁকে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। পোস্টারটির শিরোনাম ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে।’ ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে মৃত্যুর কয়েক মিনিট পূর্বে তিনি অনুরূপ আরেকটি স্কেচ আঁকেন ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ শিরোনামে। কামরুল হাসানের এসব চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে নির্ভীক প্রতিবাদী মানসিকতা, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সমাজসচেতনতাই প্রকাশিত হয়েছে। কামরুল হাসানের চিত্রকলায় লৌকিক ও আধুনিক রীতির মিশ্রণ ঘটায় তিনি ‘পটুয়া কামরুল হাসান’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত নকশা ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারি মনোগ্রাম তৈরি করার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দেশে-বিদেশে তাঁর চিত্রকলার অসংখ্য একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেমন— ঢাকা [১৯৫৫, ১৯৬৪, ১৯৭৩, ১৯৭৫, ১৯৯১, ১৯৯৫], রেঙ্গুন [১৯৭৫], রাওয়ালপিন্ডি [১৯৬৯] ও লন্ডনে [১৯৭৯]। বহু যৌথ প্রদর্শনীতেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। চিত্রকলায় অসাধারণ অবদানের জন্য কামরুল হাসান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন। সেসবের মধ্যে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার [১৯৬৫], কুমিল্লা ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক [১৯৭৭], স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার [১৯৭৯], চারুশিল্পী সংসদ সম্মান [১৯৮৪], বাংলা একাডেমীর ফেলো [১৯৮৫] এবং কাজী মাহবুবউল্লাহ ফাউন্ডেশন পুরস্কার [১৯৮৫] উল্লেখযোগ্য। তাঁর ‘তিনকন্যা’ ও ‘নাইওর’ চিত্রকর্ম অবলম্বনে যথাক্রমে যুগোশ্লাভীয়া সরকার [১৯৮৫] ও বাংলাদেশ সরকার [১৯৮৬] দুটি স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করেছে।