চিত্রশিল্পী বীরেন সোম
বাংলাদেশের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী বীরেন সোম। জন্ম ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর, জামালপুর শহরে। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটসের [বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়] চিত্রকলা বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি চিত্রকলায় বিশেষ পারদর্শিতার জন্য ছাত্রাবস্থা থেকে এ যাবৎ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সব গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের ১১ দফা, ১৯৭০-এর নির্বাচন প্রচারণা, ১৯৭১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ে ডিজাইনার হিসেবে যোগদান তাঁর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পোস্টারসহ উল্লিখিত সব আন্দোলনের পোস্টার, ব্যানার, লিফলেট ও চিত্র অঙ্কন করেন। ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’, ‘স্বাধীনতা না হয় মৃত্যু’ শিল্পী বীরেন সোমের মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য পোস্টার। ১৯৭১ সালে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণামূলক ১৭ জন বাংলাদেশি শিল্পীর গ্রুপ প্রদর্শনীর একজন উল্লেখযোগ্য শিল্পী।
শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৭০ সালে তৎকালীন বোটানিক্যাল সার্ভে অব ইস্ট পাকিস্তানে [বর্তমান বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম] যোগদান করেন। দীর্ঘ ৩৪ বছরের কর্মময় জীবনে তিনি ১০২টি জার্নাল অলংকরণ করেন, ২০০৫ সালে চিফ আর্টিস্ট হিসেবে অবসর নেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘরের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। জাতীয় শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১০টির বেশি পাঠ্যপুস্তক অলংকরণ করেন। জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনমোদনক্রমে শিশুদের উপযোগী দেশের প্রথম অঙ্কনশিক্ষার [০-৫] ছয়টি বই লেখেন, যা এখন বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যপুস্তক। আট শর বেশি বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন।
চিত্রশিল্পী বীরেন সোম দীর্ঘ শিল্পীজীবনে দেশে-বিদেশে ৬০টির বেশি গুরুত্বপূর্ণ গ্রুপ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। করেছেন ১২টি একক প্রদর্শনী। চারুকলা কলেজের গ্যালারিতে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৮ সালে, ‘শিরোনামহীন’। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় গ্যালারি চিত্রকে। ২০২০ সালে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত কর্মশালা ও গ্রুপ প্রদর্শনীতে অংশ নেন। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে তাঁর চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে। চিত্রকলার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে যেমন: আমেরিকা, ইংল্যান্ড, হংকং, কুয়েত, ব্রাজিল, ভারত, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি।
চিত্রকলার পাশাপাশি শিল্পী নিয়মিত লেখালেখিও করেন। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শিল্পী সমাজ’ ও ‘স্বাধীনতার চিত্রমালা’ তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধে শিল্পীদের অবদানের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে উল্লেখযোগ্য। ছবি আঁকা, লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দান করেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ’ লেখা লেটার হেডসহ মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু দলিল ও পোস্টারের মূল লেআউট। ২০০১ সালে ‘মুক্তিযোদ্ধা সনদ’ লাভ করেন তিনি।
শিল্পী বীরেন সোম বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতিতে স্মরণীয় অবদান রেখেছেন। চিত্রকলার নানা মাধ্যমে প্রায় ৩ হাজার শিল্পকর্ম আঁকেন তিনি। আঁকা ড্রয়িংয়ের সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। সত্তরোর্ধ্ব এই শিল্পী এখনো নিরলসভাবে চিত্র অঙ্কন চালিয়ে যাচ্ছেন।
তথ্যসূত্র: শিল্পী ও তর্ক বাংলা
শ্রদ্ধেয় গুণী শিল্পী বীরেন সোম চারু ও কারু শিল্প বিভাগে দেশের অন্যতম একজন মানুষ। দেশকে তিনি অনেক দিয়েছেন। কর্মে নিবেদিত প্রান এই মানুষটি আমাদের জামালপুরের গর্ব, কৃতি সন্তান। অত্যন্ত সহৃদয়, অমায়িক এবং মহৎ একজন মানুষ এই বীরেন কাকা। আমরা ছোট বেলা থেকেই বীরেন কাকার নাম শুনেছি, ব্যাস্ত মানুষ বলে দেখেছি কম যদিও তিনি আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। আমরা সবাই তাঁর সাফল্যে অন্যরকম আনন্দ অনুভব করি। আমি সকল জামালপুর বাসীর পক্ষ থেকে তাঁর উত্তরোত্তর সাফল্য এবং সুস্থ্য ও দীর্ঘ জীবন কামনা করছি।
মীর লায়লা ফেরদৌস সিমী
আগস্ট ০৬, ২০২১ ০৫:১০