শোপেনহাওয়ারের সুখিত দুঃখবাদ

 

গুরুভার। উৎকণ্ঠা। উদ্বেগ। আর্তি। ব্যর্থতা। হাহাকার। বিষণ্নতা। অস্তিত্বের সংকটকে বোঝানোর জন্য এসবই বহুল ব্যবহৃত শব্দ। অস্তিত্বের ভার, তার দুর্বহতা। নানা ভাষায় নানা শব্দে এর উপস্থিতি। ডেনিশ টুঙসিন [Tungsind] শব্দটি বোঝায় বিষণ্নতা বা অস্তিত্বের ভার, আর এই শব্দটির দ্বারা দার্শনিক কিয়ের্কেগার্দ অত্যধিক আলোড়িত এবং তাড়িত ছিলেন। বেছে নিয়েছিলেন এই শব্দটিকে, তাঁর লেখায়, যেন তা ঠিকঠিক রূপকায়িত করতে পারে তাঁর মনের প্রকৃত অবস্থাকে। শব্দটি দ্বারা তিনি অস্তিত্বের দুঃসহতা, চাপ বা গুরুভারকে বুঝতেন, এবং বোঝাতেন। Tung মানে দুঃখভারাক্রান্ত আর Sind মানে মন। কিয়ের্কেগার্দের ভিতর কাজ করত আধ্যাত্মিক বিষণ্নতা। এর বাইরে পিতা ও প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্কের মনস্তাত্ত্বিক চাপ, সব মিলিয়ে স্থিত আধ্যাত্মিক ও মানসিক গুরুভার, যা ছিল দুঃখময়তার থেকে ভিন্ন রকমের ওজনদার এক যন্ত্রণা। কিয়ের্কেগার্দ একেই তাঁর মনোশারীরিক বেসুরো অবস্থার কারণ হিসেবে দেখেছেন। আর এই অবস্থাকে বোঝানোর জন্যই কিয়ের্কেগার্দ এই টুঙসিন শব্দটি ব্যবহার করতেন। আমরা দেখি, একেকজন দার্শনিক একেকটি অবস্থাকে বোঝানোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন চুম্বক শব্দ আমদানি করে গেছেন। অস্তিত্বের যে অথেনটিকআনঅথেনটিক অবস্থা, এবং তার যে নেতিবাচকতা, তাকে বোঝাতে দার্শনিকেরা এসব নানা পরিভাষা ব্যবহার করেন। ফরাসি ভাষায় আঁনুই, জার্মান ভাষায় আঙস্ট তেমনই শব্দ। বুদ্ধবাদে যেমন দুঃখ, ফরাসি ভাষায় তেমনই ত্রিসতেস

শোপেনহাওয়ারের প্রিয় শব্দ ছিল উইল আর আইডিয়া বা রেপ্রেজেনটেশন। তাঁর উইল হলো এক অমোঘ, শক্তিশালী ও রহস্যময় অভীপ্সা, যা সবাইকে তাড়িয়ে বেড়ায় জীবনভর। উইল হলো স্বস্থিত সত্তা। জীবনটা এক অমিলের জায়গা, কিন্তু তিনি এই অমিলকে চিন্তা করেই কাটিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। জার্মান কবি ও লেখক খ্রিস্টোপ মার্টিন ভিলান্ডকে বলেছিলেন তিনি এই কথা: জীবন হলো এক মিসলিশে জাশে। কিয়ের্কেগার্দের জীবনে ও মনে ছিল ঈশ্বর এবং সেই ঈশ্বরের প্রকাণ্ড মহাভার, কিন্তু শোপেনহাওয়ারের জীবনে বা মনে কোথাও ছিল না কোনো ঈশ্বর বা ঈশ্বরবোধের সামান্য আঁচড় ও ওজনদারত্ব। তাঁর উইল-এ কোনো ঈশ্বর নেই। ধর্মীয় আবেগ থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন। দুই জগতের ব্যাখ্যায় তিনি ছিলেন মুখরজ্জবাস্তব আর প্রতিভাসই হলো এই দুই জগৎ। দুই জগৎ কী বোঝায়? আর কীভাবে এর উদ্ভব অধিবিদ্যার সমস্যা থেকে?

পৃথিবীর প্রথম দার্শনিক ও বিজ্ঞানী থালেস-এ এই মৌলিক অধিবিদ্যার সমস্যার বিষয়টি প্রথম দেখা দেয়। থালেস বলেন, সবকিছুই জল ভিন্ন অন্য কিছু নয়। হেঁয়ালি ও অনেকটা হাস্যকর শোনালেও, গভীরভাবে ভেবে দেখা যেতে পারে, এই সম্প্রত্যয় দ্বারা তিনি আসলে কী বোঝাচ্ছেন? তাঁর কথার গর্ভব্যাখ্যাটি এমন: ভৌতজগৎ যে-চারটি পদার্থমাটি, বাতাস, আগুন, জল দিয়ে গড়া, তার প্রথম তিনটি হলো চতুর্থটির রূপভেদমাত্র। অর্থাৎ মাটি হলো জলের ঘনীভূত অবস্থা, বাতাস জলের লঘুকৃত অবস্থা আর আগুন [ইথার, পূর্ব-ভূমধ্য অঞ্চলের উষ্ণ আকাশের] বাতাসের লঘুকৃত অবস্থা বা জলের দ্বিগুণ লঘুকৃত অবস্থা। সুতরাং থালেস যখন বলেন, সবকিছুই জল বইকি, তখন এই রহস্যবাক্যের অর্থ স্পষ্ট হলেই কেবল তার সত্যতা প্রতিভাত হয়ে ওঠে। কেন মাটিমাত্রই মাটি নয়, বাতাসমাত্রই বাতাস নয় বা আগুনমাত্রই আগুন নয়, যেমনটা তারা বাহ্যিকভাবে প্রতিভাত; তারা জলেরই অন্যতর অবস্থা, এই ব্যাখ্যায় এর বুঝ আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় হেরাক্লিতাসের কথাকেও: মাটি ক্ষয় হলে হয় জল, জল ক্ষয় হলে হয় বাতাস, বাতাস ক্ষয় হলে হয় আগুন, এবং বিপরীতটিও ঘটে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সবকিছুই বস্তুত জল’—এ বাক্যের যে অন্তরিত কথন, যা অন্তর্গত রহস্যকে উদ্ধার করে, তাকে আমরা বলতে পারি তার অধিবিদ্যক ভাষা: আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই জগৎকে বৈশিষ্ট্যান্বিত করা যায় এক বিশাল ভিন্নতায়, কিন্তু এই ভিন্নতা মৌলিক নয়, মৌলগতভাবে এই জগৎ অভিন্ন। বলা দরকার, জগতের এই অভিন্নতা যথাযথভাবে দৃশ্যমান বা প্রাতিভাসিক নয়। বরং বিপরীতটা, ভিন্নতা, হলো প্রাতিভাসিক। সুতরাং বলা দস্তুর যে ভিন্নতার জগৎই হলো দৃশ্যমান বা প্রাতিভাসিক জগৎ। বাস্তব বিবেচনায় জগৎ একটি কিন্তু তার রয়েছে বিম্বিত রূপ। অতএব এই সম্প্রত্যয় সঠিক যে, জগৎ দুটি: বাস্তব জগৎ আর দৃশ্যমান জগৎ। আধুনিক দর্শন প্রাচীন এই দ্বৈততাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছে। দেকার্তীয় দর্শন এই ধাঁধাকে ব্যাখ্যা করেছে এই ভাবে যে, জগতের সৃষ্ট বস্তুতে শুধু দুই ধরনের অস্তিত্ব রয়েছেএকটি হলো চিন্তন-বস্তু বা আত্মা, অন্যটি সম্প্রসারিত-বস্তু বা পদার্থ। তো এভাবে এ-ই শেষমেশ স্থির হলো যে, জগৎ দুই ধরনেরএকটি বাস্তব অন্যটি দৃশ্যমান।

শোপেনহাওয়ারকে মুগ্ধ করেছিল কান্ট, যেমনটা কান্টকে মুগ্ধ করেছিল হিউম। কারণ, হিউম বলেছিলেন, আমাদের মন নানা মনোছাপ [ইম্প্রেশন] ও চিন্তনের [আইডিয়া] সমষ্টি। ইম্প্রেশন হলো আইডিয়াস অব সেনসেশন বা ভৌতজগতের উপলব্ধি, আর আইডিয়া হলো ইমেজেস অব ইম্প্রেশনস, যা চিন্তনে ও যুক্তিতে সুগঠিত হয়। সুতরাং জগৎ এক দ্বিত্ব: ওয়ার্ল্ড অ্যাজ আইডিয়া হলো বাহ্যিক ভৌতজগৎ, স্থান, কাল ও কারণকার্যের রাজ্য, দৃশ্যমান জগৎ, কান্টের প্রপঞ্চ-জগৎ; আর ওয়ার্ল্ড অ্যাজ উইল হলো অন্তর্গত ভাবজগৎ, প্রপঞ্চগুণরহিত জগৎ। এখানেই শোপেনহাওয়ারের অধিবিদ্যার ভিত্তি রচিত। জগৎ হলো উইল আর আইডিয়ার দ্বৈততামাত্র।

শোপেনহাওয়ার এই অধিবিদ্যার সূত্রপাত ঘটান তাঁর নিজ নিরাশাবাদী দর্শনকে পোক্তকরণের জন্য। নিরাশাবাদী দার্শনিক আগেও অনেকে ছিলেন কিন্তু শোপেনহাওয়ার প্রথম দেখালেন যে এই নৈরাশ্য যুক্তিসংগত, কেননা জীবন আসলেই খারাপ একটা-কিছু। অভীপ্সা খারাপ, আর তাকে বাতিল করাই বুদ্ধিমানের কাজ। প্রত্যেক মানুষেরই আছে এক নগ্ন অহম্, যা নিজ স্বার্থকে রক্ষা করতে গিয়ে অন্যের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে, ফলে অনিবার্যত দেখা দেয় সংঘর্ষ। এতে জাত ভোগান্তি হয়ে ওঠে সত্তার এক অপরিত্রাণনীয় অবস্থা। সুতরাং সুখ শুধু হতে পারে ভোগান্তিকে হ্রাস করা। অতএব সুখ হলো এক ঋণাত্মক বিষয়। একমাত্র অভীপ্সার অপনোদনের মাধ্যমেই এই অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।

এই চিন্তা করেই ১৮১৮ সালে প্রকাশ পায় তাঁর দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ উইল অ্যান্ড আইডিয়া, যখন তাঁর বয়স ত্রিশ বছর। এখন অবশ্য আইডিয়া’র স্থলে রেপ্রেজেনটেশন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তারও দুই বছর আগেই বইটির লেখা সম্পন্ন হয়। মানে, আটাশ বছর বয়সী একজনের লেখাই এই বই। বলা যায় জীবনের একমাত্র বই, কারণ এরপর যা কিছুই তিনি লিখেছেন সবই এর অনুপূরণ বই অন্য আর কিছু নয়। সুতরাং দার্ঢ্য এক দীর্ঘ জীবনের এক দার্ঢ্য বই এটি। আটাশ বছরের চিন্তায় আটকে থাকা সত্তর বছরের মানুষের এ-এক অবিশ্বাস্য আত্মোপলব্ধি, যদিও প্রকাশের পর দীর্ঘ ষোলো বছরেও বইটির অধিকাংশ কপি অবিক্রীত ছিল। ১৮১৮ সালের আগস্টে ড্রেসডেনে তিনি বইটির যে ভূমিকা লেখেন, তার শুরুতেই বইটি কীভাবে পড়তে হবে, সেই কথা জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, বইটা প্রথমে দুবার পড়তে হবে: প্রথমবার ধৈর্যসহকারে যাতে দ্বিতীয় পাঠ নতুনভাবে আলোকিত করতে পারে, আর বইটি পড়ার আগে ভূমিকাটি অবশ্যই পড়তে হবে। তিনি বলেছেন, দুঃখ সব সময় ধনাত্মক আর সুখ সব সময় ঋণাত্মক। বলেছেন, জাতির জীবনে যেমন যুদ্ধবিগ্রহ তেমনই মানুষের জীবনও এক কুরুক্ষেত্র, সর্বক্ষণ শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধ। ব্যক্তির জীবনে যে আনন্দ বা উদ্যাপন, তার মাত্রানুযায়ী প্রকৃত আনন্দ পরিমাপিত হয় না, বরং ভোগান্তির হ্রাসকরণের মাধ্যমেই তা পরিমাপিত হয়।

কবিতা ও দর্শনের মধ্যে সামীপ্যের বিষয়ে তিনি বলেন: জীবন, মানবীয় চরিত্র এবং নানান অবস্থাকে চিত্রকল্পসহযোগে কল্পনাশক্তির প্রয়োগে কবি উপস্থাপন করেন, সকল গতিময়তায় তাদের আরোপ করেন আর পাঠক-শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেন, যেন এসব চিত্রকল্প পাঠকের যত দূর তাদের মানসিক শক্তিতে কুলায় তত দূর পর্যন্ত তাদের ভাবনারা পাখা মেলতে পারে। এ জন্যই কবি মানুষকে নানান ক্ষমতায় উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম, এমনকি বোকা এবং সাধুদেরও। অন্যদিকে দার্শনিকেরা জীবনকে উপস্থাপন করেন না, বরং জীবনের সুসমাপ্ত চিন্তাকেই উপস্থাপন করেন, যা তিনি জীবন থেকেই নিষ্কাশন করে থাকেন। তারপর প্রত্যাশা করেন যে পাঠক তাঁর মতোই যথার্থভাবে উপস্থাপিত চিন্তাকে অনুভব করবেন। এ কারণে তাঁকে ঘিরে জনসমাগম কম হয়। কবিকে সে কারণে তুলনা করা যায় পুষ্প-উপহারদাতা আর দার্শনিককে পুষ্পনির্যাসদাতার সঙ্গে।’ তাঁর মতে লেখক তিন ধরনের হয়ধূমকেতু, গ্রহ ও নক্ষত্র শ্রেণির। ধূমকেতু শ্রেণির লেখকেরা হঠাৎ উদিত হয়ে চমকে দেয় কিন্তু তারপরই চিরতরে হারিয়ে যায়; দ্বিতীয় পর্যায়ের লেখকেরা হলো গ্রহ বা চলমান নক্ষত্র, তারা কিছুকাল থাকে, তাদের আলোও স্থির নক্ষত্র থেকে উজ্জ্বলতর হয়, কিন্তু এই আলো ধার করা আলো, কিছুকাল পড়েই তারাও অন্তর্হিত হয়; তৃতীয় শ্রেণির লেখকেরা হলো স্থির নক্ষত্র, সবসময় থাকে আর অন্যদের প্রভাবিত করতে থাকে, তারা বাকিদের মতো স্থানকাল নির্ভর নয়, বরং স্থানকাল নিরপেক্ষ, সব দেশকালের জন্য। উৎকৃষ্ট বই পড়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, এর পূর্বশর্ত হলো বাজে বই পড়া থেকে নিজেকে বিরত রাখা, কারণ জীবনটা খুব ছোট। বই কেনা নিয়ে তিনি বলেছেন, এটা ভালো যদি একই সঙ্গে সময়কেও কেনা যায়। গ্রন্থকীটদের সম্পর্কে বলেছেন, যারা বই পড়েই সময় কাটায় আর বই থেকেই জ্ঞান অর্জন করে, তারা হলো গিয়ে ভ্রমণকাহিনি শুনে দেশ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের মতো মানুষ, অনেক বিষয়ে হয়তো তথ্য পায় কিন্তু অবশেষে দেশ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ জ্ঞান আহরণ করতে পারে না তারা। আর যারা প্রকৃতই চিন্তাশীল, তারা যেন নিজেই ভ্রামণিকের মতো সেই দেশ সম্পর্কে সরাসরি জ্ঞান নিয়ে দেশে ফিরে আসে।

দুঃখবাদী দর্শনের জনক হলেও ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন বেশ আমুদে প্রকৃতির: কামুক ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ। তাঁর লিবিডো ছিল প্রচণ্ড। অনেক কামসম্পর্ক ছিল তাঁর যদিও তা শেষ পর্যন্ত বেশি দিন তিনি ধরে রাখতেন না। নিজ শ্রেণি ও নীচু শ্রেণির বহু নারীর সাথে তিনি যৌনসম্পর্ক গড়ে তুলতেন। এ ক্ষেত্রে বাছবিচার ছিল না তাঁর। যৌনতার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন গণতন্ত্রী, তাঁর কাছে সব নারীই ছিল সমান, যদিও রাজনীতিতে তিনি ছিলেন রাজতন্ত্রের সমর্থক। নারী-সম্পর্কে ধারণাও ছিল খারাপ। আর বহুগামিতা সম্পর্কে বলেছেন, যে, এ বিষয়ে কোনো কথা নাই, আমরা বাস করি বহুগামিতার ঋতুতে, বিষয় হলো শুধু একে নিয়ন্ত্রণে রাখা। স্বাস্থ্যশুচিতার মৌলচিন্তায়ও তিনি আবদ্ধ ছিলেন। শেষ সাতাশ বছর একই জায়গায় একই রকম কঠোর জীবনাচারে তিনি রপ্ত ছিলেন। সকাল সাতটায় উঠে প্রাতরাশ না করেই স্নান সেরে নিতেন তিনি। তারপর এক কাপ ঘন কফি খেয়ে মধ্যাহ্ন পর্যন্ত লেখার টেবিলে থাকতেন। তারপর সেদিনের তরে লেখালেখি বাদ দিয়ে আধ ঘণ্টা বাঁশি বাজাতেন, যন্ত্রটির ওপর তাঁর দখল ছিল ঠিক দক্ষ পেশাদার শিল্পীর মতো। তারপর ঘর থেকে বার হয়ে এংলিশার হোফেতে মধ্যাহ্নভোজ সারতেন। এর পর ঘরে ফিরে এসে চারটা পর্যন্ত পড়তেন। তারপর রোজকার হাঁটায় বেরিয়ে পড়তেন। ঝড়বৃষ্টি যা-ই থাকুক না কেন, দুই ঘণ্টা হাঁটা ছিল একদম বাঁধা নিয়ম। ছয়টায় পাঠাগারের পাঠকক্ষে এসে দ্য টাইমস’ পাঠ করতেন। সন্ধ্যায় তিনি থিয়েটার বা কনসার্ট দেখতে যেতেন, তারপর বাইরে কোনো হোটেল বা রেস্তোরাঁয় খাবার খেয়ে রাত নয়টা থেকে দশটার মধ্যে ঘরে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়তেন। ব্যতিক্রম ছাড়া সাতাশ বছর ধরে মোটা দাগে এর আর অন্যথা হয়নি। বোঝা যায়, বাসনামুক্তির কথা তিনি বলেছেন কিন্তু একজাতীয় গাণিতিক বাসনার চর্চাও তিনি করে গেছেন। শোপেনহাওয়ারকে অনায়াসেই বলা যায় শৌখিন দুঃখবাদী, এক সুখিত দুঃখবাদী। দুঃখের কথা বলে, তাকে দার্শনিকতা দিয়ে, তিনি যেন সুখ অনুভব করতেন। এ যেন রবীন্দ্রনাথের সেই কবির মতো যিনি আজন্মকাল/ দুখের কাব্য লেখেন সুখে।’

কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে যা বলেছেন এই সুপ্ত নাস্তিক, তা যেন সকল যুগের জন্য অনন্য হয়ে যায়: বিশ্বাস হলো প্রেমের মতো: এতে কোনো জোরজবরদস্তি চলে না; আর যেকোনো জোরজবরদস্তির চেষ্টাতেই প্রেম ঘৃণায় পরিণত হয়। সুতরাং বিশ্বাসের ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তির চেষ্টা মানেই প্রকৃত অবিশ্বাসের জন্ম দেওয়া।’