হাসন রাজা ভাবের দেওয়ানা আছিন: ফকির আব্দুল কুদ্দুস
জালাল উদ্দীন রুমি বলেছেন, ‘নাচো নিজের রক্তের মধ্যে’। রাত একটু গভীর হলে নিজের রক্তের মধ্যে কিছু ঘটতে থাকে। তাই মাঝে মাঝে বাসার ছাদে পালিয়ে যাই। তারাভরা আকাশটা উপুড় হয়ে পড়ে থাকে বিশাল হাওরের বুকে। কতশত নাম না জানা পাখি, পতঙ্গরা হাওরজুড়ে ডাকছে। এই গান আনন্দ-বেদনা কিংবা বিরহের যা-ই হোক না কেন। সে এক অন্য ভাষা। জগৎ মাতার অন্তর থেকে আসছে বলে একটু হৃদয় দিয়ে বুঝতে হয়।
অনন্তের কূল থেকে হু হু করে ছুটে আসছে বাতাস। প্রায় চার কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকে ভেসে আসছে ঢোল-মন্দিরা-দোতারার সুর। প্রতি রাতেই কোনো না কোনো দিক থেকে আসে বিষাদমাখা অলস সুর। কিছুই বোঝা যায় না। তবু এই নির্জন আকাশ-মাটি-বাতাসের সুরের সাথে সিদ্ধিটানা গলার ভাঙা ভাঙা সুর আমাকে অনেকক্ষণ ধরে রাখে। অন্ধকারের অতল থেকে ছুটে আসা রাগী ঢেউগুলা সারা রাত হোমাশ হোমাশ করে ফেটে পড়বে দশ ফুট উঁচু দেয়ালে। তাতে জগতে কার কী আসে যায়?
মনের চোখে দেখি, কালো কালো অপুষ্ট এই মানুষগুলা কৃষক-জেলে-মাঝি, নাওয়ের মেস্তরি। সারা দিনের খাটুনি কিংবা একঘেয়ে জীবনের কালিকে তারা অন্তরের আলো দিয়ে, আনন্দের সুবাস দিয়ে মুছে নিচ্ছে। নিথর অন্ধকারের আড়ালে আড়ালে ভেসে যাচ্ছে কালের ধারা। সে ক্ষয়ের আগুন মুখে নিয়ে ছুটছে সমাজ-সভ্যতার পিছু পিছু।
শত শত বছর আগে এই বাতাস সুনামগঞ্জের হাওরপারের গ্রামগুলা থেকে বয়ে আনত হালতি গান আর হালকা জিকিরের সুর। হালতি গান মরতে মরতেই হাওরের পলি মাটিতে জেগে উঠেছিল বাউলগান। বেঁচে থাকতে বাউল মকদ্দস আলম উদাসী ভাই কষ্টভরা গলায় বলতেন, বাউল গান ধ্বংস হইয়া গ্যাছে! এখন উদাসী ভাইয়ের শিষ্য তরুণ বাউলশিল্পী রিপন উদাসী বলেন, আমরা বিদেশি যন্ত্র বাজাইতাম পারি। বিদেশের মানুষ বাংলা যন্ত্র বাজাইতে পারে না। তাই হাসন-রাধারমণ-করিমের স্বর্ণযুগ পার-হইয়া ডিজিটাল জামানায় আইসা বাউলগান তার মৃত্যু ঘোষণা করছে
মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমি বলেছেন, দুঃখ পেয়ো না। যা কিছু হারিয়েছে সবই আসবে অন্যভাবে। সেই বিশ্বাস বুকে নিয়ে কামে-আকামে বছরের পর বছর হাওরে ঘুরেছি। শত শত হাওরের পারে হাজার হাজার গ্রাম খুঁজতে খুঁজতে আবিষ্কার করেছি জাদুর শিকড়। সুনামগঞ্জের গ্রামগুলাতে অসংখ্য বাউল পরিবার আছে। অর্থাৎ তাঁর দাদা বাউল ছিলেন। বাউলগান গায় এই রকম নারীকে তিনি জীবনসঙ্গী করেছিলেন। বর্তমানে তাঁর ছেলে বাউল। ছেলের বউও গান গাইতে পারে কিংবা গায়। এবং এই বাউল পরিবারগুলার কর্তারা আশা রাখেন: তাঁদের পরবর্তী বংশধরেরাও দোতারা হাতে নিয়ে গাইবে, নিজের জীবনে মানবধর্ম সাধন করবে।
ফকির আব্দুল কুদ্দুস তেমনি এক বাউল পরিবারের প্রধান।সাক্ষাৎকার নিতে এসেছি ফকির আব্দুল কুদ্দুস ভাইয়ের। আমার সাথে সঙ্গ দিতে এসেছে তরুণ বাউল শিল্পী রিপন উদাসী। বাড়িতে পা দিয়ে দেখি উৎসব উৎসব ভাব। কুদ্দুস ভাইয়ের বাবা ছিলেন বাউল ভক্ত। সারা ভাটি অঞ্চলের বিখ্যাত পদক কর্তাদের অনেকেই তাঁর কাছে আসতেন। এই বাড়িতে ছোট-বড় মহাজন ও গান ভক্ত মানুষের আসা যাওয়া এখন আরো বেড়েছে। কারণ কুদ্দুস ভাইয়ের ছেলে লাল শাহ বৃহত্তর সিলেটের বাউলদের মাঝে বেশ পরিচিত এক বাউল মুখ। তার বাউল বন্ধুদের অনেকেই আজ এখানে উপস্থিত। তাই পরিচিত হলাম তরুণ ও উচ্চ শিক্ষিত বাউল আব্দুল ওদুদ এর সাথে। অবাক হলাম কুদ্দুস ভাইয়ের আশ্রয়ে থাকা আশি বছরের বুড়ো সাধক আবু ফকিরের দেখা পেয়ে। তিনি গান পাগল মানুষ। বাড়ি নেত্রকোণা। গানের টানে পথে বেরিয়ে ছিলেন তরুণ বয়সে। সংসার ও সন্তান কিছুই নাই। তাই আজো পথে পথেই ঘুরছেন।
ফকির আব্দুল কুদ্দুস ১৯৪৮ সালে সুনামগঞ্জ শহরের কাছেই জয়কলস গ্রামে জন্মেছিলে। চুয়াত্তর বছরের জীবনটা তিনি গানের আসরে বসেই কাটিয়ে দিলেন। ঘরবাড়ি, দেহ—সবখানে অনটনের কঠিন দাগ। তবু হৃদয়ের আভিজাত্যে গোটা পরিবারটাই চূড়ান্ত ধনবান। তাঁর কাছে আমার শেষ প্রশ্ন ছিল, বাউল গানের ভবিষ্যৎ কী?
কুঁচকানো চামড়ায় ঢাকা মোটা মোটা হাড়ের মানুষটা জোরালো গলায় বললেন, গান চলবে। অর্থাৎ বাউল গান বেঁচে থাকবে।
ফকির আব্দুল কুদ্দুস ভাইকে কাবু করেছে দুরারোগ্য হাঁপানি। ঘর থেকে খুব একটা বের হন না বলে মাঝে মাঝে নিজের ঘরেই আসর বসান। এক ছেলে ঢপকি নিয়ে বসে। আরেক ছেলে ঢোল। বাউল ছেলে (লাল শাহ) দোতারা হাতে নিয়ে গানে টান দিলে বাউলের বউ হারমনিতে সুর তোলেন:
‘আসরে আইসো মুর্শীদ চান গুনমণি,
অদম জাইনা মনের সাধ মিঠাও আপনি।’
—ভূমিকা ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেখ লুৎফর
শেখ লুৎফর: হাওরের সুদখোর মহাজন, বড় কৃষক, দোকানদার, হতে পারতেন মাস্টার; কিন্তু ফকির হলেন কেন?
ফকির আব্দুল কুদ্দুস: এই যে নাইন্দ্যা নদীটারে দেখছেন, এখন কত ঠাণ্ডা। বন্যার সময় তার স্রোত সব ভাসায়া লইয়া গ্যাছে। জগতের সব নিয়ম ভেঙে ফেলো, মুছে দাও সব কথা। সৃষ্টি হউক নতুন কিচ্ছার। এইডারে কয় দেওয়ানি।
লুৎফর: আপনার বাবার নাম কী?
কুদ্দুস : মুছন পীর।
লুৎফর : আপনার কয় সন্তান?
কুদ্দুস: পাঁচ ছেলে, দুই মেয়ে।
লুৎফর: সবাই কী গাইতে-বাজাইতে পারে?
কুদ্দুস: কম-বেশি সবাই পারে। একজন তো বাউলই।
লুৎফর: আপনার বাড়িতে তো প্রতিবছর ওরস হয়?
কুদ্দুস: বাপ ছিল পীর। আমার বাপের কাছে পীর-ফকির-বাউলরা আসত। দিনের পর দিন থাকত। গাইত। আমার জামানায় দুর্বিন শাহ, শাহ আবদুল করিম, কফিলদ্দীনরা আসত। শেষ বয়সে কফিলদ্দীন আর বাউল মকদ্দস আলম উদাসী বেশি বেশি আসত। একবার আসলে আর যেতে চাইত না। শাহ আবদুল করিম আমার পীর বাবা। বাবার নামে প্রতিবছর বাইশে ফাল্গুন বাউল-ফকিরের মেলা বসাই।
লুৎফর: ধর্মীয় কিংবা সামাজিক দিক থেকে কোনো বাধা আসে না?
তিনি জোরে হেসে ওঠেন। তাঁর বসার ভঙ্গি, কথা বলার ধরন, হাসি—সবখানেই উপচে পড়া একটা আনন্দ, স্বাধীনতা, আভিজাত্য।
কুদ্দুস: কোনো বাধা নাই। আমি, আমার পরিবার, গ্রাম, ইউনিয়ন, আমরা—সব গান। বাউলগান চলবে।
চলবে বলে তিনি আরেক দফা হাসেন। আমিও হাসি। আনন্দে, তৃপ্তিতে আমাদের হাসি উচ্চরব ও লয়ে দীর্ঘতর হয়। তিনি প্রায় মান ভাষাতে কথা বলতে চেষ্টা করছেন দেখে আমার ভালো লাগছে। তাঁর দীর্ঘ চুল-দাড়ি, বিশাল গোঁফ ও জীবন বোধের আলোতে, ব্যক্তিত্বে আমি প্রতি মুহূর্তে অবাক হই। আমার শ্রদ্ধা গভীর হয়। তাঁর ভরাট কণ্ঠের ভাঙা ভাঙা হাসিতে বুঝি মুক্তির স্বাদ, স্বাধীনতার খুশবু। প্রেমের সুর। যে প্রেমে মগ্ন হয়ে শত দুঃখ-কষ্ট, অনটনকে পায়ে ঠেলে হাসতে হাসতে তিনি পেরিয়ে এসেছেন চুয়াত্তর বছর, হয়েছেন একান্নবর্তী বিশাল পরিবারের কর্তা।
অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি, কুদ্দুস ভাইয়ের পাশে দীর্ঘ আর ফর্সা চেহারার একজন শান্ত-সুন্দর প্রাচীন পুরুষ বসে আছেন। মাথায় পাগড়ি। তিনি একবারও নড়লেন না, কথা বললেন না। তাঁর পাগড়ি, ধবধবে সাদা দাড়ি আর নীরবতার ঔজ্জ্বল্যে তাঁকে ওমর খৈয়াম ভাবতে ভালো লাগছিল।
লুৎফর: উনি কে?
কুদ্দুস: আমার কাছে থাকে। বাড়ি নেত্রকোনা। স্বাধীনতার পর থেকে আমার কাছেই আছে। সংসার ত্যাগী সাধক মানুষ। দুই বেলা দুই মুঠো ভাত আর গান। গান লইয়া ভালাই আছে।
লুৎফর: ওই যে দেয়ালের ছবিতে আপনার পাশে মাথায় আঁচল তুলে বসে আছেন, উনার বিষয়ে একটু বলবেন?
কুদ্দুস ভাইয়ের মুখ বুঝি একটু বেশি কালো লাগে? তিনি চোখ বুজে মাথা নোয়ান। জীবন ও সাধন-সঙ্গিনী, পরমাত্মার অর্ধেকটা, যা-ই বলুক না কেন, তিনি তো কবেই তাঁকে একা ফেলে মুর্শিদের দরবারে চলে গেছেন। একটু পরে মাথা তুলতেই দেখি হাফিজের চোখ চিকচিক করছে।
কুদ্দুস: উনি ছায়াতুন। বাউলগান খুব ভালা গাইত।
লুৎফর: উনার বিষয়ে একটু বলবেন?
কুদ্দুস: সেই সময় খুব ঘন ঘন মালজোড়া গান হইত। বাজারে বাজারে ঢোল দ্যায়া বলা হইত, করিম-ওমায়ে ঠাকুর, করিম-দুর্বিন শাহ, করিম-সফর আলী। করিম-কামালদ্দীন সবচেয়ে হিট আছিন। তবে সবখানে করিম থাকত। করিমের গান তখন আমার দেওয়ানি চরমে তুলেছে। একদিন গানে গেলাম উজানি গাঁও। লম্বা ছিপছিপা এক মেয়ে দোতারা হাতে গানে টান দিছে।
যার তার ইচ্ছা তাই বলে, বুঝি না আসল-নকল,
কেউ বলে শাহ আব্দুল করিম, কেউ বলে পাগল।
এই গান গাইয়া মেয়েটা আমার দেওয়ানি নষ্ট কইরা দিল। শুরু করলাম তার শিকড় তুকানি। খুঁজতে খুঁজতে গেলাম তার বাড়ি। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর দেখা পাইলাম। আমারে প্রশ্ন করল, কী চাও?
সোজা কইলাম, আমি গানপাগল মানুষ। তোমার গান আমার দেওয়ানি নষ্ট কইরা দিছে।
গান আমার না, করিমে লেখছে, তার কাছে যাও।
করিম আমার বাবা। আমি তাঁর কাছে বয়াত হইছি।
সে কইল, এই রকম পাইছি না তাই বিয়া বইছি না। বিয়া হইতা পারে কিন্তু আমি গান ছাড়তাম না।
আমিও কইলাম, গান ছাড়া বাঁচতাম না। আমাদের গান চলবে...
লুৎফর: বাউল কামালউদ্দীনকে একটু খোলাসা করবেন?
কুদ্দুস: বুদ্ধির জোর বেশি আছিন। সাধনা আছিন না। মালজোড়ার আসরে উঠে খালি বুদ্ধির খেইল দিত। গভীরতা আছিন না। তার বাড়িৎ গ্যায়া বই দূরে থাক আমরা একটা কাগজের টুকরা পাইছি না। অথচ সেই সময় দুর্বিন শাহ, কফিলদ্দীন সর্বক্ষণ কোরআন-হাদিস ঘাঁটাঘাঁটি করত। দুর্বিন শাহকে জ্ঞানের সাগর বলা হইত।
লুৎফর: শাহ আবদুল করিম বিষয়ে একটু বলবেন?
কুদ্দুস: সব্বনাশ! এই রহম সাধক আছে? অতিরিক্ত চাউল ঘরে নিছে না। কাইল আসলে কাইল দেখবে। কোনো দিন বায়না কইরা গান গাইছে না। সরলার বাপ-মা নাম রাখছিন বৈশাখী। এত সরল! করিম তারে সরলা কইয়া ডাকতে শুরু করে। সরলা করিমরে কোনো দিন বাজারের কথা কইছে না। অভাবের কথা কইছে না। ভক্তদেরকে দ্যায়া বাজার করাইছে। করিমের হাতে বাজারের ব্যাগ, লাউ-কুমড়া...এই সব কেউ জীবনে দ্যাখছে? (সারা ঘরে দুম হাসি ওঠে, অনেকক্ষণ হাসি চলে) করিম পরের গান গাইছে না। সে নিজে লেখছে, সুর দিছে, গাইছে। সেই ভাটিতে জলমান্দারুকা গ্রামে গান হুনবার গেছি। আসরে করিম-সফর আলী। করিম গাইছে—
মায়ে করলা মুরুগ জবো, আইয়া চাচা খাইল না,
চালছানিত কামলা চাচা দিলায় না...
ঠিক এই সময় হালকা, ছোটখাটো গড়নের একজন নারী (কুদ্দুস ভাইয়ের ছেলে বাউল লাল শাহর স্ত্রী সাদিনা বেগম) ট্রে হাতে আমাদের সামনে এসে বলেন, মাফ করবেন, এইযেন আমার শ্বশুর কইছইন, চালছানিত কামলা চাচা দিলায় না...কথাটা ঠিক এই রকম না। তাইনের বয়স হইছে। মাঝে মাঝে কথায় ভুল হয়। চালছানিত কামলা চাচা দিলায় না..., এইটা হইল করিমের আঞ্চলিক গান। জলমান্দারুকার আসরে করিম ভাই গাইছিল:
ভাবিলে কী হবে গো, যা হইবার তা হইয়া গ্যাছে,
জাতি-কুল-যৌবন দিয়াছি...
আমি চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে সরে বসি, মা এখানে একটু বসবেন?
কুদ্দুস ভাই মমতার হাসি হাসেন, বও মা, বও...।
সাদিনা বেগম: জলমান্দারুকায়, ‘ভাবিলে কী হবে গো...’ করিম ভায়ের গলায় এই গান শুনে, এক যুবতী নারী কাঁদতে কাঁদতে আইয়া করিম ভাইয়ের পায়ে পড়ে, বাবা তুমি আমার বুকের সব কথা কইয়া দিছ।
করিম ভাই কইল, আমি আমার গান গাইছি। তোমার কথা কইতাম ক্যানে?
লুৎফর: আপনি গাইতে পারেন?
সাদিনা বেগম: একটু একটু।
লুৎফর: কোনো আসরে গাইছেন?
সাদিনা বেগম: ইস্কুলের অনুষ্ঠানে বহুবার গাইছি।
লুৎফর: কতটুকু পড়ছেন?
সাদিনা বেগম: এসএসসি পাস।
লুৎফর: বিয়ের পরে?
সাদিনা বেগম: একবার। আমাদের এখানে যে ওরস হয়, সেই মঞ্চে গত বছর গান গাইছি।
লুৎফর: পরিবার, প্রতিবেশীদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
সাদিনা বেগম কিছু বলবার আগেই তার শ্বশুর কুদ্দুস ভাইয়ের মুখটা তৃপ্তির হাসিতে ভরে ওঠে, সবাই খুশি হইছে। বউ মা রে... উৎসাহ দিছে।
লুৎফর: হাসন রাজা বিষয়ে কিছু বলবেন?
কুদ্দুস: হাসন রাজা ভাবের দেওয়ানা আছিন। সিংহাসনে বইসা বইসা গান লিখছে। যখন কিচ্ছু ভাল্লাগছে না, তহন হাওরের ঘাটে আইয়া বইয়া রইছে। নাইওরী লইয়া নাও এই গাঁও-সেই গাঁও চলাচল করে। পেয়াদারা নাও তালাশ কইরা সুন্দরী নারী পাইলে রাজা সাহেবের কাছে আনে। তিনি হুঁঙ্গা-চুমা (হুঁঙ্গা: প্রিয় মানুষের নাকে নাক লাগিয়ে আদর করা) দিয়া ছাইড়া দিতা। এক নারী গিয়া তাঁর মায়ের কাছে বিচার দিল। মা বললেন, হয় হাসন ভালা হইত নাইলে শেষ হইত। তিনি মাঝিরে বললেন, আমারে লইয়া হাসনের ঘাটের দিকে যাও। ঘাটের কাছে নাও যাইতেই পেয়াদারা জোর করে ঘাটে নাও লাগায়। রাজা সাহেব নাওয়ের পর্দা সরিয়ে দেখেন, মা বসে আছেন। তিনি লাম্বা হইয়া মায়ের পায়ে পড়েন। মা বলেন, না, তোমার ক্ষমা নাই। এই তো হাসন মায়ের পা ধরে কেঁদে ওঠে:
মাটির পিঞ্জিরার ভিতর বন্দি হইয়ারে,
কান্দে হাছন রাজার মন ময়না রে...
সাদিনা বেগম: হাসন রাজা কোনো নষ্ট চরিত্রের মানুষ আছলা না। তাইন ভাবের পাগল ছিলা। যারে ভালা লাগত, তারে গলার মালা দিয়া দিতা। আর হুঁঙ্গা-চুমা দিতা মনে খারাপ কিছু লইয়া না। তাইন মরমি কবি। সব সময় ভাবের জগতে থাকতা। তাই সুন্দরের প্রতি শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় এইসব করতা।
লুৎফর: হাসন রাজার গান বিষয়ে একটু বলবেন?
সাদিনা বেগম: তাইন জমিদার ছিলা। কোনতার অভাব আছিল না। হাওরের কুড়াপক্ষীর মতন মনের আনন্দে বিভোর হইয়া গান লেখতা। অনেক বড় মহাজন। তাইন কইছইন:
দেখিয়া সুন্দরীর রূপ-রঙ্গ,
লইলাম আমি সঙ্গ।
আমার বাড়ির উপর দিয়া
যায় রে...সুরমা গাঙ্গ।
আবার কইছইন:
হাছন রাজা কয়,
আমি কিছু নয় রে...আমি কিছু নয়,
হাছন রাজা নয়।
লুৎফর: আর শাহ আবদুল করিম?
সাদিনা বেগম: তাইন সবতা হারায়া শূন্য থেকে গড়তে গড়তে কুতুব মিনার বানাইছইন। তাইন কঠিন কথা সবচে সহজে কইছইন। এই জন্য তাইন বিশ্বজুড়ে ছড়ায়া পড়ছইন। যেমন:
বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে,
কি যাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে...
আবার তিনি আরেক গানে কইছইন:
যারতার ইচ্ছা তাই বলে, বুঝি না আসল-নকল,
কেউ বলে শাহ আবদুল করিম, কেউ বলে পাগল।
আলাপের ফাঁকে ফাঁকে গান চলছিল। হারমোনিতে বসেছেন আব্দুল ওদুদ। দোতারায় রিপন উদাসী। (রিপন আর ওদুদ ভাই এই বাউল পরিবারের কেউ না। তারা কুদ্দুস ভাইয়ের ছেলে লাল শাহর ঘনিষ্ঠজন) ঢপকি বাজাচ্ছে কুদ্দুস ভাইয়ের ছোট ছেলে। সে পেশায় কৃষক। এই আসর ঘিরে কমপক্ষে পাঁচ প্রজন্মের মানুষ বসে আছি। মনে মনে আমি লোভী হয়ে উঠছি। বাউলগান বিষয়ে এই এক আসর থেকেই আমি তরুণতর বাউল ও আশি ছুঁই ছুঁই বাউলের মতামত জানতে পারব। আমি রিপন উদাসীর দিকে তাকাতেই সে হাতের দোতারা কোলের ওপর রেখে দেয়।
লুৎফর: বাউলগান কি থাকবে?
রিপন উদাসী: জগতে কিছুই থাকবে না। থাকবে শুধু ধর্ম আর অন্ধকার। মানুষ দিন দিন পাতলা হইতেছে। হালকা হইতে হইতে এখন আকাশে উড়তাছে। এখন বাউলগানও ওড়াউড়ির মতন চলতেছে।
সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে নেতা নেতা চেহারার এক ভদ্রলোক এসেছেন। বাউল লাল শাহ পরিচয় করিয়ে দিলেন, আব্দুল ওদুদ ভাই। দীর্ঘদেহী মানুষটার চিকন গোঁফের আড়ালে চুপ করে বসে আছে এক চিমটি শান্তি। প্রথম দেখাতেই আপন আপন লাগছে।
লুৎফর: ওদুদ ভাই কী করেন?
ওদুদ: স্যানিটারি ব্যবসা করি।
লুৎফর: আপনি কী গান গান, লেখেন?
ওদুদ: দুইটাই করি।
লুৎফর: নিজের বিষয়ে একটু খুলে বলবেন কি?
ওদুদ: আমি কামিল পাস (এমএ)। ব্যবসা করি। আমার বাবা ছিলেন মাদরাসার আরবি শিক্ষক। ভাইয়েরাও মাদরাসা শিক্ষিত এবং শিক্ষক। মা-বাবা জীবিত থাকতেই বাউলগান আমাকে আপন করে নেয়। কারি আমির উদ্দীন আমার উস্তাদ। এইটা অন্য ধরনের ব্যাপার। একেবারে ভিতর থেকে জেগে উঠার মতন। আপনি সবার মাঝে সবকিছুতে থেকেও নাই। ভিতরে ভিতরে চোরা স্রোতের মতন একটা আনন্দে শত ভিড়েও আপনি আপনার মাঝে একা এক জগতে থাকতে পারবেন। এই ব্যবসা, গরম গরম টাকা, সন্তান...। এই সব আপনাকে গিলে ফেলতে পারবে না। টাকা একটা বিরাট ব্যাপার। টাকা আবিষ্কারের পর থেকেই মানুষ পচতেছে। এই ধ্বংস থেকে বাঁচার জন্য, মানুষ হয়ে উঠবার জন্য বাউল সাধনার বিকল্প নাই। এই বোধ থেকেই করিম ভাই বলেছিলেন, ‘একদিন দুনিয়ার সব মানুষ বাউল হবে।’
লুৎফর: বাউল সঙ্গের জন্য আমার মতো আপনিও কি বউয়ের কাছ থেকে ধাতানি খান?
ওদুদ: প্রথম প্রথম। কিন্তু একদিন বৃষ্টির সময় গলা ছেড়ে আমার লেখা একটা গান তাকে শুনাই। সে মুগ্ধ হয়ে আমাকে বাউল চর্চার অনুমতি দেয়। বাউল সাধনা আমাকে সৎ ও সুন্দর জীবন দিছে।
লুৎফর: বাউলগান নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
ওদুদ: বুঝতে পারছি আপনি কী বলতে চাইছেন। এই যে নদীপারে সারি সারি করচগাছগুলো দেখছেন? এইগুলার শিকড় থেকে নতুন গাছ হয়। গাছটা আপনি কেটে নিলেও তার শিকড়গুলো থেকে প্রতিবছরই নতুন নতুন চারা হবে। এই পানি-মাটি আর হাওরের বাতাস আমাদের পরবর্তী বংশধরদেরকেও আমাদের মতো কম-বেশি গভীরের দিকে টানবে। এই প্রকৃতিই তাদেরকে বাউল বানাবে। যে ভাবে রাধারমণ, হাসন, করিম শাহ হয়েছেন, সেই ভাবেই হবে। মানুষ যেই ভাবে মানুষ হয়, সেই ভাবে আমি আমারে লইয়া ব্যস্ত আছি।
দিনের রোদ অনেকটা মরে এসেছে। এখন উঠলেও ঘরে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তবু কুদ্দুস ভাইয়ের ছেলে, বাউল লাল শাহর দিকে মন দিতেই হয়।
লুৎফর: রাধারমণ বিষয়ে কিছু বলবেন?
লাল শাহ: রাধারমণ তো বিশাল। তাইন কইছইন:
‘চিনিয়া মানুষের সঙ্গ লইয়ো,
পাষাণ মনরে বুঝাইও।
লুৎফর: কবি গান গেছে, হালতি গান গেছে, মালজোড়া মরেছে, বাউলগান আর কত দূর?
লাল শাহ: কীর্তনের একশ্রেণির শ্রোতা, ওয়াজের একধরনের শ্রোতা কিন্তু বাউলগানের আছে সব শ্রেণির ভক্ত।...কথাপ্রধান বাউলগান বুঝিতে যে পারে, জন্মে জন্মান্তর থাকবে মানুষের হৃদয়ে।
লুৎফর: আপনি তো বাউল মকদ্দস আলাম উদাসীর প্রিয় শিষ্য। উদাসী ভাইয়ের বিষয়ে একটু বলবেন?
রিপন উদাসী: আমি যতখানি দেখছি, তাঁর মতো সাধক শুধু সুনামগঞ্জ না, বাংলাদেশেও বিরল। তাইন কইছইন:...
আল্লাহু নাম জপ রে মন, দিন গেলে দিন আর পাবে না।
বাতাস বাহির হইয়া গেলে, মাটির দেহ আবর্জনা।
এই বাউল পরিবারের প্রাণ হচ্ছে সাদিনা বেগম। দেখি বাউল ও বাউলগান বিষয়ে তাঁর মতামত কী?
লুৎফর: বাউলগান বিষয়ে আপনার চিন্তা কিংবা দুশ্চিন্তা আছে কি?
সাদিনা বেগম: অবশ্যই। রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত আছে না? এইগুলা অক্ষয়। বাউলগানও আমরার রক্তের মইধ্যে অক্ষয় হইয়া আছে। এক রক্ত থেকে আরেক রক্তে। একশ বছর পরে হলেও দেখবেন, সুনামগঞ্জের মাটিতে আরেকজন হাসন কিংবা করিম আইব।
লেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগলো বাউল গান হালুতি গান ঘাটু গান নিয়ে আরো গবেষণা করে আরো ভালো ভালো লিখা দিবেন বলে আশা বাদ
বাউল আজিজ রেজা
নভেম্বর ০৫, ২০২২ ০৯:০৩