একটি ডোরিয়ান সন্ধ্যা
কথাসাহিত্যিক হাসান মাহবুব ভাই এসেছিলেন। আমরা তাঁকে ডাকি হামা ভাই। ধানমন্ডিতে বিকেল তখন ক্রমশ সোনালি হারাচ্ছে। অন্ধকার নামতে পনেরো মিনিটও বাকি নেই। গ্লোরিয়া জিন্সের সামনে আমরা একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের মাথার ওপর একটা ফলবতী আমড়াগাছ আঁধার হয়ে আছে।
কী পড়ছি বা লিখছি যখন এ কথা উঠল, বললাম, “সর্বশেষ ‘পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে পড়েছি হামা ভাই।”
হামা ভাই বললেন, “প্রচুর নাম শোনা বই। কেমন লাগল।”
“মন্ত্রমোহিত মোহিত করে রাখল অস্কার ওয়াইল্ড বুড়োটা”, আমি বললাম। “অবশ্য জীবনে তিনি বুড়ো হওয়ার অবকাশ পান নাই।”
“তাই নাকি।”
“চল্লিশ মতো হয়েছিল বোধয় বয়স। আর তখনই পৃথিবীকে বললেন, মা ধরিত্রী, আসি তবে। আধেকটা হইলো দেখা, আধেক রইলো বাকি। একদম মনের মতো একটা লেখা পড়েছি, হামা ভাই। মনে হলো, এরই জন্যে যেন দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে ছিলাম।”
“আরও বিস্তারিত শুনতে হবে তাহলে।”
“সে ক্ষেত্রে আরেক কাপ চা বলি।”
“গরম না। ঠাণ্ডা কিছু নাও।”
২
উপন্যাসে তিন চরিত্র প্রধান। চিত্রশিল্পী বেসিল, ভূস্বামী লর্ড হেনরি, আর ধনাঢ্য যুবক ডোরিয়ান গ্রে।
বেসিল একজন আদর্শবাদী চিত্রকর। শিল্পের প্রতি তার অনুরাগ এক তুরীয় স্তর স্পর্শ করেছে। এ লোক হৃদয়বান আর নিছক বন্ধুবৎসলই নন। বন্ধুকে নিয়ে রীতিমতো স্বর্গ পর্যন্ত যেতে চান। বন্ধু যদি নরকে যেতে চায় তো তিনিও স্বর্গের দুয়ারে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়বেন-এমন।
এরপর লর্ড হেনরি। লর্ড হেনরিকে বলা যায় দার্শনিক। তবে তার নিজের ধারার। পৃথিবীর সমস্ত ঘটনা, সম্পর্কের সমস্ত সূত্র, আর মানুষের প্রকৃতি নিয়ে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গি আঁধারবাচক। যেমন কেউ হয়তো বলল, বাহ্, কী সুন্দর লাইলাক ফুটেছে। হেনরি বলবেন, সুন্দর কদর্যতাকে ডাকে।—তার কথা না ফেলা যায়, না নেওয়া যায়।
সবশেষে ডোরিয়ান গ্রে। এ একেবারে একজন আত্মমোহিত তরুণ। কিন্তু সরল। সুন্দর, সংবেদনশীল আর স্পর্শকাতর হৃদয় তার। ডোরিয়ানের সুন্দরের প্রতি তার মোহ প্রায় বেসিলের সমতুল্য। আর নিজের প্রতি মুগ্ধতা নার্সিসাসের মতোন। বা আরও বেশি কিছু। পারলে ডোরিয়ান নিজের সঙ্গে নিজেই সঙ্গম করে—এমন। যদিও ধনাঢ্য, ধনাঢ্য মানে মাথাখারাপ ধনাঢ্য। তবু জীবন তাকে কিছু প্রতিকারহীন বিয়োগব্যথা দিয়েছে। তাই তার সামনে দুটো পথ। একটা গভীরতার, একটা অন্ধকারের। এবং, কোনো কোনো গভীরতা, অন্ধকার।—আমার এ কথাটা কিন্তু লর্ড হেনরির মতো হয়ে গেল।
এ প্রসঙ্গে বলি, যদিও ডোরিয়ানের সঙ্গে বেসিলেরই প্রথম বন্ধুত্ব হয়, আর লর্ড হেনরি মূলত ছিল বেসিলেরই বন্ধু, তবু, শেষমেশ ডোরিয়ানের ওপর হেনরির প্রভাবই বড় হয়ে আসে। চাঁদের ওপর সূর্যের প্রভাব যতটা বড়।
৩
হামা ভাই নতুন বই লিখছেন। গল্পের বই। নাম হবে জড়জ। জড় থেকে অজ। শুনে আমি বলেছিলাম, “জড় তো জন্ম দেয় না। জন্ম দেয় না বলেই সে ক্লীব। অথচ আপনি বইয়ের নাম রাখছেন জড়জ। মানে ওই জড় জন্ম দেয়। তাই কি?”
“কী বলো। জড় থেকে তো জন্ম হয়।”
“প্রথাগত জন্ম যেটা সেটা হয়? হয় না তো।”
“কী বলো হয় না। পাগল নাকি। দিব্বি হয়।”
হামা ভাই গল্পে প্রতীক নিয়ে কাজ করেন এবং ওই জগৎটাই তাঁর। ওটা যে সব সম্ভবের জগৎ তা নয়, তবে ব্যাখ্যার জগৎ। সমস্ত ব্যাখ্যা সেখানে বিশ্বাস্য। সীমাহীন প্রতীকের যে জগৎ, সঙ্গত কারণেই সে জগৎ অসীম।
পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে-র আলাপের সঙ্গে প্রতীকের সদালাপ প্রাসঙ্গিক। প্রতীকবাদ বিষয়ে আমরা যখন অজ্ঞ, তখনও অজান্তে একে কতবার ব্যবহারে এনেছি! অজান্তেই কত কিছুরই তো উত্তরাধিকার আমরা বহন করি।
প্রতীকবাদ নিয়ে মালার্মের ভাবনা পড়েছিলাম একটা লেখায়।
লেখার নাম শিল্পসাহিত্যে প্রতীকবাদ। লেখক মুহম্মদ সালাহউদ্দীন। শিল্পসাহিত্য ডট ব্লগস্পট-এ ছাপা হয়েছিল।
স্তেপান মালার্মে তাঁর বন্ধু অঁরি কাজালিসকে লিখেছিলেন, শিল্পীর উচিত ছবির মতো হুবহু তুলে না ধরে, বাদামের মতো সৃষ্ট বস্তুটিকে তুলে ধরা।
হয়তো একজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। জবুথুবু। মলিন পোশাক। আমি বললাম, হেঁটে যাচ্ছে একটা সংখ্যা। তারপর, একটা মেয়েকে কে যেন রেখে গেছে। টকটকে লাল শাড়ি পরা। সে বসে আছে। চলতি পথে তাকিয়ে দেখছে সবাই। লিখলাম, কে যেন রেখে গেছে এক ফালি করে কাটা লাল তরমুজ।
এভাবে লিখেছি এবং আঁকছি। কত সহজে। এতটাই নিজের করে পেয়েছি এই গড়নটাকে, যেন এ ছিল। যেমন বাংলা বর্ণমালায় লেখার সময় মনে পড়ে না যে এ আমার নিজের আবিষ্কার নয়। এ যেন অনাদি থেকে ‘আছে’। আমি একে ‘পেলাম’। বসে আছে ফালি কাটা তরমুজ—বলার সময় একবারও মনে পড়েনি এমন লেখার অবকাশ কারা যেন প্রতিষ্ঠা করে গেছে।
ইউরোপীয় প্রতীকবাদ কী করে পৃথিবীর বাতাসে এমন বাতাস হয়ে মিশে গেল?
ইউরোপে এই প্রতীকবাদ ব্যক্ত হওয়ার আগেই তা মানুষের প্রাণতন্তুতে ছিল। আমাদের সৃষ্ট পুরাণগুলোর চেয়ে বড় প্রমাণ এর আর কী হতে পারে?
উদাহরণ—এক আলোকিত দেবী এসে চলতি পথে থামিয়ে আমাকে বললেন, পেছনে তাকিয়ো না। পেছনে তাকালে পাথর হয়ে যাবে।
এ পাথর তো সে পাথর নয়। পেছনে তাকালে আমি যে জড় হয়ে যাব। আমার থেকে কেউ আর অজ হবে না। তাই মানা করা হয়েছে। কে করেছে? দেবী? বেশ, কে এই দেবী। এই দেবী হলেন আমার অনুধাবন। আমার অচিন্তার অন্ধকারে হঠাৎ আলোকায়ন। যাকে আমি একে দেবীর মূর্তিতে ব্যক্ত করলাম। পুরাণের পাতায় এর প্রশিক্ষণ, প্রদীক্ষণ।
প্রতীকবাদ তো যেন অনাদি। এ যেন ছিল, আমি শুধু একে পেলাম। তবু মানুষের ভিড়ে কিছু “পেলাম” বলতে বিপত্তি আছে।
যেহেতু সবাই পায় না, সেহেতু, কেউ এসে বলে, “কী পেলে? আরে এ তো বোকার স্বর্ণ!”
তখন আমাকে দায় নিয়ে প্রমাণ করতে হয়, যা পেলাম তা বোকার স্বর্ণ নয়। বলি, “এই দেখুন এই যে তার আণবিক সংকেত। এই যে তার পারমাণবিক সংখ্যা।”
এরপর আদিখ্যেগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে যায়। বলে, “অ। এমন তো আমিও দেখিয়েছিলাম সেবার।”
৪
প্রতীকবাদের সুবর্ণ সময় অনুমান করতে পারি ১৮৬০/৭০ থেকে ১৯০০।
পনেরো শ ও ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপীয় রেনেসাঁর পর কিন্তু বেশ একটা মানবতাবাদের ঢেউ আসে। আমার ধারণা, সেই ঢেউ প্রতীকবাদকেও নাড়া দিয়েছে, যদিও অত জোরে নয়। ঢেউয়ে ধাক্কার পর, সে ফিরে যাওয়ার সময় দেয় পেছনটান। ১৯০০ সাল যত কাছে আসতে থাকল, মানবতাবাদ ক্রমশ বিমানবতাবাদে আক্রান্ত হতে থাকল।
এ কথার বলার কারণ আছে। পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে হয়তো প্রতীকবাদী উপন্যাস, কিন্তু প্রতীকবাদী সময়ের একেবারে শেষকালে এসে তার জন্ম। ১৮৯৫ সালে। যে কারণে এই যে হেনরি চরিত্রটা—এ বড় গুরুত্বপূর্ণ। ইনি হলেন নতুন সময়ের এই বিমানবতাবাদের প্রতীক। এই সময়টা—যখন বিমানবিকতা প্রকট হয়ে উঠছে, সম্ভবত সেই সময়টাকেই ইউরোপ বলছে ডিকেডেন্ট। এই ডিকেডেন্ট ধারা তার শোর তুলেছে প্রতীকবাদী আন্দোলনের শেষাশেষি।
ডিকেডেন্স-এর একটা চমৎকার বাংলা পরিভাষা দিয়েছে কেউ। সৃজনচ্যুতি। মানে সব ক্রমশ জড় হয়ে উঠছে, কেউ আর অজ হচ্ছে না। সৃজন থেকে চ্যুত হচ্ছে।
ডোরিয়ান গ্রে-র সামনে অস্কার ওয়াইল্ড ক্রমশ ডেকে আনলেন প্রতিকারহীন দুঃখ। সেই দুঃখ তাকে গভীরতার দিকে নিয়ে চলেছে। এই গভীরতায় আলো নেই। কারণ, এটা সৃজনচ্যুত গভীরতা। ডিকেডেন্ট গভীরতা। ডোরিয়ানের মুমূর্ষু মানবতাবোধ তাই উঠে বসতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। আর পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে-তে অস্কার ওয়াইল্ডের তৈরি হেনরি চরিত্র যেহেতু সেই ডিকেডেন্স-এর প্রতীক, সেহেতু ডোরিয়ান যখন অমানুষ হয়ে উঠছে, হেনরি আরও হাওয়া দিচ্ছে। কিন্তু লাগছে কার। লাগছে বেসিলের। কারণ, বেসিল সেই মানুষ, যে বন্ধু নরকগামী হলে সে নিজে স্বর্গের দরজায় স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে। বন্ধু ছাড়া স্বর্গে যাবে না।
সাহিত্যে বন্ধুত্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর করুণ ট্রায়োগুলোর একটি—বেসিল-হেনরি-ডোরিয়ান গ্রে।
তো পঙ্কে ডুবে যেতে যেতে ডোরিয়ান গভীরতায় পৌঁছে গেল। সেখানে আঠালো অন্ধকার। নাকে মুখে লেপে যায়, শ্বাস রোধ করে। মারে।
তবে মরলে আলো!
এভাবে ডিকেডেন্ট উপন্যাস হয়েও পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে বোধয় সেই মানবতাবোধের দিকে নিয়ে গেল। শিল্পে যে মানবতাবোধ রেনেসাঁর উপহার। যে কারণে ডিকেডেন্ট যুগে রচিত হয়েও পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে খাঁটি প্রতীকবাদী উপন্যাস। যেন তাতে প্রতীকবাদের শেষ যুগের কালো লাগেনি। যেভাবে হাসের পালক থেকে কাদাজল খসে পড়ে। তবে শেষ পর্যন্ত এতে লেখার কিছুই এসে যায় না। ও আমাকে সুন্দরের পথে ক’ পা এগিয়ে নিয়ে গেল, এটাই মুখ্য। বাকি সব অপসৃত হবে।
তবু এ আলোচনা হলো, কারণ, লেখকের সংগ্রাম আর ইপ্সা বুঝতে এ কাজে আসে। লেখক তো মানুষ। মানুষকে বুঝলে তো মানুষকে ভজলে।
৫
প্রতীক প্রতীক করছি, কিন্তু প্রতীকটা স্পষ্ট হলো কোথায়। স্পষ্ট হলো ডোরিয়ান গ্রে-র ছবিতে।
বেসিল একটা ছবি এঁকেছিল ডোরিয়ান গ্রে’র। পৃথিবীতে এত নিখুঁত সুন্দর ছবি বুঝি আর আঁকা হয়নি। সুন্দরের এমন স্মারক যেন স্বর্গেও দুর্লভ। এ ছবি এত ভালো হয়ে গেল যে বেসিল ভাবলেন, এর ভেতর তিনি এতখানি ঢুকে গেছেন যে, এটা এখন কাউকে দেখানো মুশকিল। কেউ এটা দেখে ফেললে লজ্জার ব্যাপার হবে।—এই যে বেসিল এমন ভাবলেন, আমাকে কিনে নিলেন সঙ্গে সঙ্গে। সৃষ্টি একটা স্তরে উন্নীত হয়ে গেলে সেটা বোধয় লুকিয়ে পড়তে চায়। কারণ না লুকোলে সে তার আলোয় সব পুড়িয়ে ফেলবে।
ছবি দেখে হেনরির মাথা ঘুরে গেল। হেনরি বৈষয়ী, আর দর্শনের দিক থেকে ঋণাত্মক মানুষ। ছবির সুন্দর তাকে কোনো বক্রোক্তি করাতে পারত। তা পারল না। তার মানে হেনরির নেতিরও একটা সীমা আছে।
ছবি দেখে ডোরিয়ান গ্রে পাথর হয়ে গেল। এত সুন্দর প্রতিকৃতি সে আগে আর কখনো দেখেনি। ইউরোপে সেই যুগটা অভিজাতদের পোর্ট্রেট আঁকানোর যুগ। নিজের এত সুন্দর পোর্ট্রেট ডোরিয়ান আর কখনো দেখেনি। এই সুন্দরের তীব্রতা এত বেশি যে তার চোখ ছবি থেকে ঘুরে এলো নিজের দিকে। শিল্প তার উত্তীর্ণতার একটা স্তর পর্যন্ত নিজের দিকে দৃষ্টি টানে। আর সেই স্তর পেরিয়ে গেলে, দর্শক নিজের দিকে ফিরে তাকায়। ডোরিয়ান অস্ফুটে কেবল এটুকু বলতে পারল, আমি এত সুন্দর!
আর এই কথা শুনে বেসিল বুঝে গেলেন, যে সুন্দরের শরীর তিনি এঁকেছেন, তার শরীরের সুন্দর ওপরের প্রলেপ মাত্র। ডোরিয়ানের ভেতরটা ঠিক ফাঁপা। তিনি কষ্ট পেলেন। কিন্তু সেই ফাঁপা যে আর ফাঁপা নেই, সেখানে বেসিল নিজেই প্রবেশ করেছেন, সেটা তিনি অস্বীকার করতে পারলেন না।
এইটুকুর ভেতর অস্কার যে গভীরতার কাছে আমাকে নিয়ে গেলেন, সেই গভীরতা অন্ধকার।
ডোরিয়ান বলল, ঈশ্বর, তবে কি আমি এতই সুন্দর? এই ছবির আমি এতটাই ‘আমি’! যদি সত্যিই আমি এমন অপরূপ হয়ে থাকি ঈশ্বর, তবে তুমি কালের করাতে এই ছবিকে ফালি কোরো। বিনিময়ে আমাকে রেহাই দাও।”
হেনরি তো তার মনেই আগেই ভীতি প্রবেশ করিয়েছে। সুন্দরকে হত্যা করবে জরা। করবেই। আজকের জরা সামনের যৌবনের রসদ। তুমি রসদের রসপ্রবাহ কেটে দাও ডোরিয়ান! সব রস নিজের ভেতর জমিয়ে জারাতে শেখো। স্বার্থপর হও। স্বয়ং ঈশ্বর স্বার্থপর!
ডোরিয়ান প্রার্থনা করলেন। ঈশ্বর শুনলেন সেই রহস্যময় প্রার্থনা। বন্ধুরা বৃদ্ধ হলো। ডোরিয়ান তরুণ রয়ে গেল। আর শুধুই কি তরুণ? সে মন্দের শেষ সীমায় পৌঁছে গেল। কতটা মন্দ হতে পারে, কোন পথে? সেই আদর্শও বাতলে দিয়েছিল হেনরি। ‘একটা বই’ পাঠিয়ে। যার পাতার পর পাতাভরা ডোরিয়ানের মতোই এক তরুণের কার্যকলাপ। সেই সব, যেসব ডোরিয়ান নিজেও পড়তে ভয় পায়। তবু পড়ে যাওয়া থামাতেও পারছে না!
ডোরিয়ান সমস্ত রস নিজের ভেতর জমায়। রসেরও বিষ আছে। ডোরিয়ান তাতে বিকৃত হতে থাকে। কিন্তু তার রক্তমাংসকে সেই বিকৃতি স্পর্শ করল না। স্পর্শ করল তার ছবিকে।
একদিন বেসিল যেমন বলেছিল, ডোরিয়ান গ্রের ছবি সে কোথাও দেবে না। কারণ, ওই ছবির ভেতর বেসিল নিজে এত বেশি প্রকটভাবে উপস্থিত। পারে তো ছবিটা লুকিয়ে ফেলে। বন্ধু ডোরিয়ানও আরেক পথে সেই একই জায়গায় উপস্থিত হলো। সেও ছবি কাউকে দেখাবে না। ওটা তার লুকিয়ে রাখা তটস্থতার উপকরণে পরিণত। কারণ, সেই ছবির ভেতর বিপজ্জনকভাবে সে বিকৃত হয়ে চলেছে।
অস্কার ওয়াইল্ড এখানে কী নিয়ে খেললেন। খেললেন আমাদের ভেতরকার এই পৌরাণিকতা নিয়ে: প্রতিটা মানুষের বুকের ভেতর তার নিজের একটা মানসমূর্তি আঁকা আছে। আমাদের প্রতিটা পুণ্য তাকে আলোকিত করে। প্রতিটা পাপে সেই মানসমূর্তি বিকৃত হয়। অস্কার সেই মানসমূর্তিকে তুলে নিয়ে এসে বলল, ডোরিয়ানের ছবি।
৬
কেন আমার মনে হয়েছে—আমার মন এমন একটা বইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল? হয়তো আমি বেসিলের সঙ্গে নিজের মিল পেয়েছিলাম বলে। হয়তো আমি ডোরিয়ানের সঙ্গে নিজের মিল পাচ্ছিলাম বলে। আর দুজনের দিক থেকেই সাবধানী হেনরি আমার থেকে দূরে। এতটাই দূরে যে তাকে অস্বীকার করি। আর অস্বীকার করি বলেই সে কাছে।
সব ভাব ভাষা পায় না। যারা ভাষা দিতে চায়, তাদের কারও কারও মস্তিষ্কের ঘটে বিকৃতি। অস্কার ওয়াইল্ডেরও কি সেই বিকৃতি ঘটেছিল? ‘পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে’ নামে এই প্রতীকবাদী উপন্যাস রেনেসাঁ যুগের মতোই আদর্শবাদী পরিসমাপ্তি টানে। অস্কার ওয়াইল্ড যেন বেসিল। আর অস্কার ওয়াইল্ডের আপন ব্যক্তিগত জীবন চরম ডিকেডেন্ট জীবনে পরিণত হয় শেষ দিকে। যেন তিনি অবিকল ডোরিয়ান!
প্রতিকারহীন দুঃখ যাকে গভীরতার দিকে নিয়ে গেছে। এবং সেই গভীরতার পথ অন্ধকার।
পিকচার অব ডোরিয়ানে গ্রে-র কিন্তু সেই অন্ধকারেই আলোক নক্ষত্র ফোটানোর কথা ছিল। কিন্তু—কথা তো কত কিছুই থাকে।
৭
উপন্যাস এক বিবর্তনময় অভিযাত্রা। আমার মনে হয়েছে, বিবর্তনে অবিকশিত থেকে যান চরিত্র হেনরি। প্রটাগনিস্টের ওপর এত বড় প্রভাব রাখা চরিত্রটির এমন বিবর্তনহীনতা কেন? হয়তো আমার বোঝার ভুল। আর যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে তো এটা উপন্যাসের একমাত্র দুর্বলতা, নয় এটাই উপন্যাসের অনবদ্য শক্তি।
সবাই বদলেছে। হেনরি বদলাননি। সবাই পরিণতি পেল। তিনি পরিণতিহীন। হয়তো তিনি মানুষের অনুভূতির মতোই ধ্রুব। তাই বদলাননি। আবার তিনি মানুষের মৌলিক প্রবণতাগুলোর মতোই একগুঁয়ে। তাই বদলাননি।
কিছু পেছনগল্পের অভাব আছে পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে-তে। আমাদের জীবনের গল্প যেমন মাঝখানের কোনো পাতা থেকে শুরু আবার গল্পের মাঝখানেই কোথাও শেষ হয়ে যায়। তবে অনুপস্থিত পেছনগল্পও যে কখনো একটা কাল্পনিক উপন্যাসকে বিশ্বাসযোগ্যতা দিতে পারে, পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে তার উদাহরণ। কোথাও কোথাও শ্যামকে না পেলেও কুলের শ্রী বাড়ে।
আমার আরও মনে হয়েছে এ দার্শনিক উপন্যাসের ফর্ম অনুসরণীয়। সম্ভবত বিশ্বসাহিত্যে অস্কার ওয়াইল্ডের তর্কযুদ্ধের ফর্ম সবচেয়ে নান্দনিক অনুসরণ যাঁরা করেছেন তাঁদের ভেতর আমাদের রবীন্দ্রনাথও আছেন।
পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে-র [১৮৯৫] তর্কশৈলী, গোরায় [১৯১০] ছায়াপাত করেছে বলেই মনে হয়।
৮
আমি পড়েছি সুনীলকুমার ঘোষের অনুবাদ। অনুবাদটা পড়লে অস্কার ওয়াইল্ড হয়তো নেচেই উঠতেন। এত সাবধানী শব্দচয়ন! ভাষার এক পাত্র থেকে আরেক পাত্রে রস আঁজলা করে স্থানান্তর চলেছে। কিছু ছলকে, কিছু চুইয়ে তো পড়বেই। সেটুকুর কথা বলা রূঢ়তা। আমি সেই রূঢ়তা করব না। সুনীলকুমার ঘোষের কাছে ঋণী হয়ে থাকলাম।
৯
পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে-তে শিল্প ও শিল্পীকে অস্কার ওয়াইল্ড মর্যাদা আর প্রাণময়তার তীরে নিয়ে গেছেন। সেই তীরে দাঁড়িয়ে আমার বুকের ভেতর একটা ভয় অনুভূত হয়েছে। আনন্দের মতো ভয়। এই ভয় আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে চাই না।
হামা ভাই নিকোটিন ক্যাফেইন সব ছেড়েছেন। কোক খেতে গিয়ে শুনলাম ছেড়েছেন চিনিও। একদিকে বাতাসে তামাক পুড়ছে, আরেকদিকে হামা ভাই জলে চুমুক দিতে দিতে আমার এসব বাকচাতুরী শুনছেন।
অন্ধকার বাড়ছে। প্রদর্শনীর সময় ফুরোতে দেরি নেই। বললাম, “হামা ভাই, ভেতরে চলুন। আজ একটা নতুন ছবি এনেছি আমার। নাম বিনয়াকী। দশ দিন ধরে এঁকেছি। আজ প্রদর্শনীর দেয়ালে উঠবে। এখনো মোড়ক খুলিনি। আপনি খুলবেন।
বেসিল শেষমেশ মন বদলেছিল। ‘ডোরিয়ান! ভেবেছিলাম ছবিটা কোনো দিন কাউকে দেখাব না। কিন্তু মন বদলেছি। তুমি শুনে খুশি হবে ভাই। প্যারিসে একটা প্রদর্শনীতে দেখাব ভাবছি। ছবিটা কদিনের জন্য একটু ধার দিতে পারো?’
খানিক বাদে ধানমন্ডিতে প্রদর্শনীর দেয়ালে উঠল আমার আঁকা ‘বিনায়কী’। আমি মুখ ভোঁতা করে তাকিয়ে থাকলাম। হামা ভাই ভুরু কুঁচকে ছবি দেখছেন।
বাইরে বিকেল তার সোনালি হারিয়েছে কবেই। কিছুক্ষণের ভেতর গোধূলি-লালিমার সবটুকু ক্ষয়ে যেতে আর দেরি নেই। সময়টুকুর নাম দিলাম ডোরিয়ান সন্ধ্যা।