ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা

 

১৯৯২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপক ডেরেক ওয়ালকট [১৯৩০-২০১৭] প্রধানত কবি ও নাট্যকার। পেশায় ছিলেন অধ্যাপক। জন্মেছিলেন ছোট্ট এক ক্যারিবীয় দ্বীপ সেইন্ট লুসিয়ার রাজধানী কাস্ত্রিসে। শ্বেতাঙ্গ পিতামহ আর কৃষ্ণাঙ্গ পিতামহীর এক বর্ণসংকর বংশপরম্পরায় জন্মেছিলেন। লেখাপড়া করেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যারিবীয় অনেক স্কুলে পড়িয়েছেন। কিংস্টন জ্যামাইকা এবং ত্রিনিদাদ গার্ডিয়ানে লেখালেখিও করেছেন। সেইন্ট লুসিয়া আর্টস গিল্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেছেন। কিন্তু সব ছাপিয়ে তিনি আকাশ স্পর্শ করেছিলেন কবিতার ডানা মেলে। আর সেই নিরুপম শূন্য থেকে, অপার উচ্চতা থেকে পৃথিবীকে দেখেছিলেন নাটকের অনুপম চশমা পরে। তাঁর বিস্ময়কর এক নাটকের নাম ড্রিম অন মাংকি মাউন্টেন

সেই ২০০৮ সাল। আমি মাত্র অনার্স পরীক্ষা শেষ করলাম। বাংলাদেশে তখন সেনা প্রভাবিত তত্ত্ববধায়ক সরকারের শাসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এর কিছুদিন আগের খণ্ড খণ্ড বিক্ষোভে অংশ নিয়ে আমিও যেন ৬৯ কিংবা ৯০র গণ-অভ্যুত্থানের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে হয়ে দিন পার করছিলাম। তারপর, জীবনে ওই প্রথম, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনুভব করছিলাম একধরনের দ্বিধা, সংশয় কিংবা শঙ্কা। একদিন, এক অস্থির সকালে, এস এম হল থেকে হেঁটে হেঁটে নীলক্ষেত বাকুশাহ মার্কেটে গিয়ে এ-দোকান ও-দোকানে উঁকিঝুঁকি মারছিলাম। হঠাৎ পুরোনো এক বইয়ের দোকানেই আবিষ্কার করি ডেরেক ওয়ালকটের ড্রিম অন মাংকি মাউন্টেন এবং কালেক্টেড পোয়েমস: ১৯৪৮-১৯৮৪। ওয়ালকটের নাটকেই প্রথম প্রবেশের চেষ্টা চালালাম। উত্তর-ঔপনিবেশিক নাট্যরচনার সমুদয় প্রতিস্পর্ধার এক পরম স্বপ্নের চিহ্ন হয়ে ধরা দিয়েছিল এই নাটক। আঙ্গিকে-বিষয়ে, কাঠামোর তুমুল ভাঙচুরে, গীত আর নৃত্যের প্রয়োগ-নৈপুণ্যে, ঘটনার আঘাত-প্রতিঘাতে, বাস্তবতার স্বপ্নময় রূপায়ণে, গল্পের রাজনৈতিক অর্থে, আধ্যাত্মিকতার কাব্যিক সংকেতে আমি বিস্ময়ে একেবারে তাল হারিয়েছিলাম। পাশ্চাত্যের আধুনিকতাবাদী নাট্যের বিপরীতে, সেই ষাটের দশকের শেষপাদে, সত্তুর দশকের শুরুতে, ওয়ালকট কি এক বিস্ময়কর নাটকই না সৃষ্টি করেছিলেন। আমি আরও আলোড়িত হয়েছিলাম নাটকের প্রস্তাবনায় নিপীড়িত বিশ্বের বিপ্লবী তাত্ত্বিক ফ্রানৎস ফানোঁর বক্তব্য যোজনার কারণে। কারণ, সেই সময়, আমাদের অনেকের হাতে হাতে মাত্র ঘুরছে ফানোঁর বই আমিনুল ইসলাম ভূইঁয়ার অনুবাদ জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত (দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ)। নাটকটির অনুবাদ বা রূপান্তর কিছু একটা করতে তখন তীব্রভাবে তাড়িত হয়েছি। কিন্তু অতি মুগ্ধতার কারণে টেক্সট থেকে নিজের আর বিচ্ছেদ ঘটাতে পারিনি। তাই এক পৃষ্ঠাও কাজ এগোয়নি। 

নাটকটি নিয়ে কিছু করতে ব্যর্থ হয়ে ওয়ালকটের কবিতায় মন দিয়েছিলাম। সেই নিমগ্ন সময়ের একটি ছেঁড়া চিহ্ন হলো লাভ আফটার লাভ কবিতার অনুবাদ। তীব্র প্রেম যেমন ডুবিয়ে রাখে, তেমনি হঠাৎ ভাসিয়ে চলে যায়। আমার জীবন থেকে কীভাবে যেন ডেরেক ওয়ালকট হারিয়ে গেল। এরপর প্রায় এক দশক কেটে যায়। ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ ওয়ালকটের মৃত্যু আমার কাছে তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনে। তাৎক্ষণিক শোক আর পুরাতন ভালোবাসার টানে অনুবাদ করি ওয়ালকটের দুটো কবিতাদ্য ফিস্ট এবং মিডসামার, টোবাগো।

ওয়ালকটের কবিতা যেন আত্মজৈবনিক। তবে এ জীবন অন্য জীবন তালাশ করে। স্বপ্ন আর যুক্তির সহাবস্থান দিয়ে নির্মিত সময়ের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দিতে সক্ষম ওয়ালকটের কবিতা। ওয়ালকটের সময় উৎপাদন করে নিজেরই এক দানব। কখনো কখনো এ যেন হয়ে ওঠে শারীরিক বর্ণ আর ভুল সময়ের দৈত্য। তবে তাঁর বহু কবিতা পাঠককে এক দার্শনিক অনুভবের জগতে ডুবিয়ে দেয় অগ্রিম কোনো কিছু না বলেই। ডেরেক ওয়ালকটের কবিতায় স্মৃতি আর হারানোর বেদনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হয়ে ওঠে নিজের অপর সত্তার খোঁজ। 

ভূমিকা ও অনুবাদ: শাহমান মৈশান

 

ভালোবাসার পর ভালোবাসা

সময় আসবে
যখন তুরীয় আনন্দে
তুমি নিজেকেই শুভেচ্ছায় সিক্ত করবে
পৌঁছে তোমার নিজের দরজায়, নিজের আয়নায়
আর সবাই হাসবে এই অপর সম্ভাষণে
আর বলো, বসো এইখানে। খাও।
তুমি আবার ভালোবাসবে আগন্তুককে, যে ছিল তোমারই আপন সত্তা
তাকে মদিরা দাও। রুটি দাও। তোমার নিজের হৃদয় ফিরিয়ে দাও
তাকে, আগন্তুককে, যে ভালোবেসেছে তোমাকে
তোমার সারা জীবনকে, যাকে তুমি উপেক্ষা করেছো
আরেকজনের জন্য, যে তোমাকে হৃদয় দিয়ে চেনে।
বইয়ের তাক থেকে তুলে নাও প্রেমপত্রগুলো
ফটোগুলো, বেপরোয়া টীকা-টিপ্পনীগুলো
আয়না থেকে তুলে নাও তোমার নিজের বিম্ব।
বসো। এই তোমার জীবন ভোজ


মুঠোয় ধরা আঁকশি

আমার হৃদয় ছিল মুঠোয় ধরা আঁকশিতে
একটু শিথিল হলো আর আমি ব্যাকুল হলাম
উজ্জ্বলতা; কিন্তু এটি বাঁধল
আবার। কখন আমি ভালোবাসিনি
ভালোবাসার যন্ত্রণাকে?  আর এ নিয়ে গেছে
ভালোবাসাকে উন্মাদনায়। এ হলো শক্ত
মুঠো উন্মাদের,
পাতালে নিমজ্জমান আর্তনাদের পূর্বে
এ হলো আঁকড়ে ধরা শেষ খড়কুটো অকারণের

শক্ত করে ধরো তাহলে, হৃদয়। এই ভাবেই কমপক্ষে তুমি বাঁচো

 

টোবাগোর চৈতালি দিনে

বিস্তারিত সূর্য-শিলা রচিত সমুদ্রতটেরা

শ্বেত উত্তাপ।
সবুজ একটি নদী

একটি সেতু,
তপ্ত বাকলের হলুদ পাম গাছেরা
গ্রীষ্মযাপনের বাড়িগুলো ভেদ করে
ঢুলু ঢুলু হয়ে থাকে আগস্ট জুড়ে

দিনগুলো আমি ধরে রেখেছি,
দিনগুলো আমি হারিয়ে ফেলেছি,
দিনগুলো এমন বাড়ন্ত যেমন মেয়েরা,
আমার আশ্রয় খোঁজা এই হাতেরা