শহীদুর রহমানের অগ্রন্থিত কবিতা
শহীদুর রহমান [১৯৪২-১৯৯২] বিশেষভাবে পরিচিত তাঁর কথাসাহিত্যের জন্য; কথাসাহিত্য বলতে কেবল গল্প; কারণ, একটি উপন্যাস তিনি লিখতে চেয়েছিলেন, শেষ করে যেতে পারেননি। শহীদুর রহমান সবচেয়ে প্রশংসিত ও পরিচিত হয়েছিলেন তাঁর ‘বিড়াল’ গল্পের জন্য, জীবিত অবস্থায় এ নামেই একটি গল্পগ্রন্থ বের হয়েছিল। ষাটের দশকে যাঁরা বাংলাদেশের সাহিত্যকে নানান বিষয়-বৈচিত্র্যে ভরিয়ে তুলেছিলেন, তাঁদের মধ্যেও অন্যতম তিনি। কিন্তু স্বভাব ছিল একা থাকার, কখনোই ছিল না প্রচারের প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ। তাই গুরুত্বপূর্ণ হয়েও মূলধারার সাহিত্যের ইতিহাসের বাইরে তাঁকে থাকতে হয়েছিল, এবং এখনো তা হচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের রাজনীতি ব্যক্তিকে অনেক সময় বড় করে দেখে, ব্যক্তির কাজকে নয়। এই বিষয় সত্যতায় মেলানোর জন্য আমাদের কাছে শহীদুর রহমান খুবই বাস্তব উদাহরণ।
আমরা আগে যে বিষয় নিয়ে কথা বললাম, তাতে শহীদুর রহমানকে গল্পকার হিসেবেই পরিচিতির দাগে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু তিনি কেবল গল্প লিখেই ক্ষান্ত হননি। একাধারে কবিতাও লিখেছিলেন। ব্যাপারটা ঘটেছে অনেকটা জীবনানন্দের মতো। জীবনানন্দ কবিতা বাদে অসংখ্য কথাসাহিত্য রচনা করেছিলেন। কিন্তু কী কারণে যেন তিনি তার বড় অংশই ছাপেননি। মৃত্যুর পর তা ছাপা হয়েছিল। শহীদুর রহমানের বেলায়ও এই বিষয় ঘটেছে। যদিও তিনি জীবনানন্দের মতো এতো লিখে যাননি। তবে যা লিখে গেছেন, তা কম হলেও সাহিত্যের গুণে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। জীবদ্দশায় যে বিড়াল নামের গল্পগ্রন্থ বের হয়েছিল, তার পেছনে বড় ভূমিকা তাঁর পরিবার রেখেছিল। ঠিক মৃত্যুর পর যে কাব্যগ্রন্থ শিল্পের ফলকে যন্ত্রণা বের হয়েছিল, তা-ও বের হতে পেরেছিল পরিবারের ভূমিকায়; মেয়ে অদিতি সাদিয়া রহমান ও পুত্র অভিক সানোয়ার রহমানের কল্যাণে, ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
শিল্পের ফলকে যন্ত্রণা কাব্যের কবিতাগুলোর রচনাকালের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ষাটের দশকের শুরু থেকেই শহীদুর রহমান কবিতা রচনা শুরু করেছেন, এবং তা নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত চলমান ছিল। ফলে এই কথা বলার উপায় নেই, শহীদুর রহমান মৌসুমি কবিতার লোক। তিনি কম লিখেছিলেন, তারও কম প্রকাশ করেছিলেন। এই বিষয় তাঁর নিজের জীবনের যাপনপদ্ধতির সাথেও সম্পৃক্ত ছিল। পিতা চেয়েছিলেন তাঁকে ডাক্তার বানাতে। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সাহিত্যিক হবেন, সাহিত্য পড়বেন। ফলে সামন্ত পিতা তাঁকে সব সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বেশ অর্থকষ্টে কেটেছিল তাঁর শিক্ষাজীবন। পিতার টাকার অভাব না থাকলেও তাঁকে শিক্ষার ব্যয় বহনের জন্য টিউশনি কিংবা সাংবাদিকতার মতো পেশাকে বেছে নিতে হয়েছিল।
শহীদুর রহমান আগাগোড়া ‘আধুনিক’ সাহিত্য-প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত। যে আন্দোলন ঢাকায় হয়েছিল ষাটের দশকে। যাঁরা ছিলেন বুদ্ধদেব বসুদের ঘরানার। সেই বৈশিষ্ট্য বারবার তাঁর গল্পগুলোতে এসেছে। গল্পের বিষয় আর প্রকাশভঙ্গির যৌথ বৈশিষ্ট্য এই বিষয়কে বড় বেশি স্পষ্ট করে তুলেছে। সমান কথা খাটে তাঁর কবিতার বেলায়ও। শিল্পকে কেবল শিল্পের বিচারে দেখার বৈশিষ্ট্যই তাঁর কবিতায় স্পষ্ট হয়েছে। সামাজিক সত্য যতই নির্মম আর ক্রূর বাস্তবতার হোক না কেন, ‘আধুনিক’ সাহিত্য সর্বদাই প্রকাশিত হয় একটি ‘নিটোল আপেলের’ মতো করে। কবিতা লেখার বেলায় তিনি সর্বদা সচেষ্ট থেকেছেন এই ব্যাপারে। ফলে কবিতায় বিমূর্ততার বিষয় হাওয়ার মতো করে চিন্তায় ধাক্কা দেয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নানামাত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন তাঁকে সেই পরিস্থিতি থেকে সরিয়ে দিতেও সফল হয়েছে। তাঁর কবিতা সেই সাক্ষ্য আমাদের দেয়। শিল্পের ফলকে যন্ত্রণা তাঁর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ পাঠ করলে এই বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
—সংগ্রহ, সংকলন ও সম্পাদনা: সোহানুজ্জামান
পটভূমিকায়
দ্যাখো, তোমার জোড়া চোখ মেলে
কী অদ্ভুত দিনের সাড়া দিগন্তে।
একখানা সোনালি ওড়না উড়ছে প্রান্তের দ্বারে
আর প্রান্তরের সবুজের সমারোহ
জীবনের গতি-উচ্ছলতার প্রারম্ভিক পদক্ষেপ।
ঘাস ফড়িঙের গায়ের রঙ আজ পেয়েছে তোমার অন্তর।
আমাদের অন্তরে তারুণ্যের ডাক
পাহাড়ি জলধারার মতো কল্লোলের গান সুর তোলে
দিগন্তের ইশারায় ছায়ানট ছায়া ফেলে কথা বলে।
আজ
আমরা বাঙ্ময়।
আজ আমরা উদ্বেলিত হৃদয়ের চরম সঙ্গীতে
আর শান্তি ডাকে।
ভাদ্র ১৩৬৯ [১৯৬২]
পলাতক
আমায় ডেকো না। তোমাদের হল্লায়
তোমরা তো সর্বপ্রাণের জোয়ারে ভাসো
নিষ্প্রাণ ধুলো মোর মেরু মজ্জায়
ঘুরপাক খায়, তোমরা জীবন ত্রাসে,
তোমরা সবাই জীবনকে ভালোবাসো
আমি জীবনের ছন্দ পুড়িয়ে ফেলে
বলি কবিতাকে, তাকে উঠে যত কালো
তোমাদের চোখে বেহদ্দ বে আক্কেলে—
তাই আমি ম্রিয়মাণ মাথা ঝুঁকে
তোমাদের শির সূর্যকে ছুঁতে চায়,
তোমাদের ছাতি প্রশস্ত, মোর বুকে
শুভ্র কেশের গুচ্ছরা চিল্লায়
তোমরা কবিতা, আমি বুনো বাঁশঝাড়
রাত্রে জোনাকি দিনে হুতুমের বাস
ভরা পদ্মায় জোয়ারের তোলপাড়
তোমরা সকলে, আমি মরা মোথা ঘাস
আমাকে ডেকো না, তোমাদের হল্লায়
আমি নেই আর আমি ঘুম দিতে চাই।
ঘোড়াশাল
আমার কিশোর বেলা কেটেছে যেখানে—ঘোড়াশাল
সে এক গ্রামের নাম, অবারিত মাঠের চত্বরে
স্মৃতির জোয়ার বয়—অমার্জিত কিশোর দামাল
আমি, লিচু আম জাম দাঁতে কেটে পুরেছি উদরে।
যেখানে গাজীর গান শুরু হলে ভিড় হতো বেশ
অতি পুরানো ভাসান কিম্বা ছোরাদের অষ্টগান
জমাতো আসর খুব। কেষ্টযাত্রা ছড়াতো আবেশ
অথবা নৌকা বিলাস লায়লী মজনু, রূপবান,
সাঁজের বেলায় সব চ্যাংড়া মিলে সাধতো গলা
‘কালা আমায় পাগল কৈরাছেরে ঘরে রৈ কেমনে’—
হরেক রকম কণ্ঠ খেলতো পাখির মতো খেলা,
ডাবা হুঁকো মুখে মুখে ঘুরতো সদাই, পড়ে মনে
ধান ভানা মেয়েটিরে—চালাকি রাঙা বড়ুর মুখে
ঢেঁকির পাড়ে তালে পাছা নাচা প্রাণে দিতো সুখ।
[৩১.০৩.১৯৬৪]
ঋতুর আমেজ
গুহামুখে কে জ্বালাবে আলো
আসাদ সাঈদ প্রশান্ত আজাদ
ক্লীবত্ব পাড়ি দিয়ে দ্যাখ কি বিশাল
মেট্রো কাঁপে চম্পার কোরকে
চৈত্রের অশান্ত হাওয়ায় শোন
পরাগ চুরির দুরন্ত হুল্লোড়
কাঁচুলী নিয়েছে কেড়ে বায়স রঙা
সে কোন মায়াবী রাতের প্রহর
জংয়ে জংয়ে ক্ষয়ে গেছে কবিতা
একুশের গুহামুখে কপাটবিহীন
দূরের মেরুন আলোয় দেখা যায়
দুই ধাপ সিঁড়ি, বাকিটুকু দেখা যায় না।
আলো জ্বেলে আজ এই বিপন্ন সময়ে
ব্যক্তিগত পবিত্রতাহীন।
কে হবে?
[০৫.০৫.৬৪]
কেমন কেমন
শ্যামল সবুজ দিগন্তরে
উড়লে পাখি ভালোই লাগে।
ঘাসের কোলে শিশির কণা
ধরতে গেলে মায়াই জাগে
তবু পাখি ধরে রাখি
বন্দী করি খাঁচার ঘরে
তবু ঘাসের শিকল করে
শিশির উড়াই বাতাস ভরে
কেন করি জানি না তা
শুধু জানি করি এমন
বুকের পাখি ধরলে চেপে
কাঁদে যেন কেমন কেমন।
[০৬.০৪.৭৮]
মৃত্যুর আগে
মৃত্যুর আগে আমি
কবিতাকে কাছে পেতে চাই
কবিতাকে ভালোবাসতে চাই
যেমন ভালোবাসতে চাই
আমার মাকে, আমার পুত্রকে, আমার কন্যাকে
এবং আমার স্ত্রীকে
আমার মৃত্যুর আগে আমি
অমনি নিবিড় করে পেতে চাই কবিতাকে।
আমার মৃত্যুর আগে আমি দেখতে চাই
ভোরের লাল সূর্যের মতো
কবিতা রাঙায়েছে পূর্ব আকাশ
আমার মৃত্যুর আগে আমি দেখতে চাই
সোনালি ডানার চিল হয়ে কবিতা
দুপুর রোদ্দুরে তারাফুল ফোটাচ্ছে
আলাউদ্দীন খাঁর সেতার হয়ে
কাঁপছে দুপুরের রোদ্দুর
আল্লারাখার তবলা হয়ে
নাচাচ্ছে দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ আকাশ
সাজ্জাদ হোসেনের সানাই যেন
দোলা দিচ্ছে বিকেলের পড়ন্ত আলোকে।
মৃত্যুর আগে দেখে যেতে চাই
মাঝ মেঘনায় মাঝির সবল পেশীতে
এবং কবিতা ঢেউ খেলছে উত্তাল
চরম বিলের টাবুরে নাউ এর গলুইয়ে
মাঝির কণ্ঠ হবে।
‘বাইয়া যাইবা কোন ঘাটে
ভিড়াইবে সোনার নাও
তিস্তা পাড়ের মেয়ের ঘাম ঝরা চিবুকের
কালো তিলেও হবে গাড়িয়াল বন্ধুরে।’
মৃত্যুর আগে যদি দেখতে পেতাম
নিদাঘে বটের ছায়ায় হরিয়াল
হয়েছে কবিতা।
[২১.০৪.৮৭]
কোথায় যাবো
লম্পটের হাত ধরে কুমারীর মতো
থর থর কাঁপছে যখন পৃথিবী
তখন হে ঈশ্বর বলে দাও
আমি কোথায় যাবো।
শুঁড়িখানায় মদের উষ্ণতায়
গেলে কি ভালো
নাকি মাঘের শীতে
ডবল লেপ মুড়ি দিয়ে
শরীর গরম করবো
হায় আল্লাহ
আজানের ধ্বনিও যে কাঁপছে,
কুমারীর অলকের মতো
বিদ্যার্থীর হাত থেকে ভয়ে
বই পড়ে যায়।
অ্যাটমিক ভূমিকম্প চলছে ব্রহ্মাণ্ডে
তাই দেখে বগল বাজায়
সিংহাসন সমারূঢ়
শ্বাপদ শকুন
ওধারে ভাগাড়ে গরু পড়েছে
মানবতার লাশে পচন ধরে
মায়ের শোকাশ্রু হলো
বেশ্যার বিলাস
ঠোঁটের লিপস্টিক খেতে
ছুটে চলে তরুণের দল
চল্লিশোর্ধ্ব সেজেছে সেমিজে
সূর্যোদয়ের আগে তার ঊরু
দুফালি করতে হবে
তারপর ক্ষেতে দেব লাঙ্গল
অজন্মায় ভরে গেল দেশ
অকাল হবার আগে
প্রফেট বলে দাও
আমি কোথায় যাবো
মসজিদে না গ্রন্থমেলায়
সেখানেও যদি
মানুষ খুঁজে না পাই।
[২৫.০১.৮৯]
সবগুলো কবিতাই পড়েছি | খুব ভাল লাগল |
ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়
অক্টোবর ০৩, ২০২২ ২৩:২১