পরমানন্দ হলো একজন শিল্পীর কাজ করার সময়

 

মনিরুল ইসলাম

চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলামের জন্ম ১৭ আগস্ট ১৯৪৩ সালে, জামালপুরের ইসলামপুরে। পৈতৃক ভিটা চাঁদপুর। বাবার চাকরিসূত্রে কিশোরগঞ্জে তাঁর শৈশব কেটেছে। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। পাঠ শেষে এখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন ১৯৬৬ সালে। শিক্ষকতার ১ বছর পর ১৯৬৯ সালে স্পেন সরকারের বৃত্তি নিয়ে সে দেশে যান উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য। এরপর থেকে স্পেনেই স্থায়ীভাবে বাস করে শিল্পচর্চা করছেন। স্পেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাঁর বহু একক ও যৌথ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি স্পেন ও মিসরে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চারুকলা প্রদর্শনীতে বিচারক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বিশেষ খ্যাতিমান ছাপচিত্রের জন্য। এচিংয়ে তিনি এমন একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছেন, যা স্পেনে মনির স্কুল বলে পরিচিত। ১৯৯৭ সালে তিনি স্পেনের রাষ্ট্রীয় পদক পান। ২০১০ সালে তিনি ভূষিত হন স্পেনের মর্যাদাপূর্ণ সম্মাননা দ্য ক্রস অব দি অফিসার অব দি অর্ডার অব কুইন ইসাবেলায়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননার পাশাপাশি তিনি দেশে ১৯৯৯ সালে একুশে পদক, শিল্পকলা একাডেমি পদকসহ বিভিন্ন পদক ও সম্মাননা পান। শিল্পী মনিরুল ইসলামের সাক্ষাৎকারটি নেন মোস্তফা জামানসাখাওয়াত টিপুশাহমান মৈশান। 

মোস্তফা জামান: আজকের আলাপটা মূলত শিল্প বিষয়ে আপনার একটা সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, জীবন, দর্শন নিয়ে। আমরা তো আপনার সাথে আগেও অনেকবার আলাপ করেছি। তো সেগুলো থেকে কিছু যদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আসে আসলো, তা নিয়েও আলাপ। এখানে মূলত শাহমান মৈশান আর সাখাওয়াত টিপুওদের কিছু প্রশ্ন আছে, সেগুলো আপনার কাছে জানতে চাইবে।

সাখাওয়াত টিপু: প্রথমত আপনি বেড়ে উঠেছেন কোথায়? শিল্পের সঙ্গে আপনার জীবনের সম্পর্কটা কীভাবে ঘটল?

মনিরুল ইসলাম: প্রথম হলো পরিবেশ ও পরিবারএই তো! আমার জন্ম জামালপুর জেলার ইসলামপুরে, ১৯৪৩ সালে। জন্মের তিন মাস পর বাবা চলে আসলেন ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ। চতুর্থ থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত কিশোরগঞ্জের একটা মাইনর স্কুলে পড়াশোনা করি। ওটা হিন্দুপ্রধান এলাকা ছিল। একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল। ওই পরিবেশে ছোটবেলা থেকেই এটাসেটা আঁকিবুঁকি করতাম। এটাকে আর্ট বলেন, আঁকাউকি যা-ই বলেন, ওই বয়সে চিত্রকলা কী বা চিত্রশিল্পী কী জিনিস বা শিল্পী হওয়া বা শিল্প কী রকম, তার স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না।

বিদেশে দেখা যায়, শিশুকালে বাচ্চাদের নিয়ে যায় মিউজিয়ামে। তখন মিউজিয়াম বা চিত্রকলা কী, শিল্পী কী, তার কিছু একটা ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। আর আমাদের তো পনেরো-ষোলো বছর পর্যন্ত কোনো ধারণাই ছিল না। তবে ভিতরে একটা অন্তর্দৃষ্টি ছিল আঁকতে হবে আমাকে। তা ছাড়া আঁকার কোনো ট্রেন্ড ছিল না। প্রথম প্রথম বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি আঁকতামরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, পাকিস্তানের কবি ইকবাল। তখন তো এটার একটা ট্রেন্ড ছিল।

শাহমান মৈশান: আইয়ুব খান...

মনির: হ্যাঁ, আইয়ুব খান? না, না আইয়ুব খান তো পরে আসলো! লিয়াকত আলী খান, বার্নার্ড শ, কাজী নজরুল ইসলাম, এঁদের ছবিই আঁকতাম। তবে আঁকার কোনো প্রসেস ছিল না, ট্রেসিং হতো না। এমনি আঁকতাম, ড্রাফট করে আঁকতাম, সঠিক কিছু জানা ছিল না। কোনো ড্রয়িং টিচারও ছিল না।

ফিল্মস্টারদেরও ছবি আঁকতাম। আমার মনে আছে, আমাদের বাসাটি টিনের, বড় একটা বাঁশের পার্টিশন ছিল। তো এটাকে আমি খবরের কাগজের ওপর ভাতের মাড় দিয়ে পুরাটা ঢেকে দিলাম। ওটাতে চক পাউডার দিয়ে নানা কিছু আঁকলামপাহাড়, নারকেলগাছ, নদী, হাঁস...নানা কিছু। এখন এটাকেই আমরা বলি ম্যুরাল। ম্যুরালকে ল্যাটিন-এ বলে ওয়াল। সাধারণ লোক যেটাকে সুন্দর সিনারি বলে। তখন আমাদের স্কুলে একটি ম্যাগাজিন ছিল, পড়ুয়ার পুথি। আশ্চর্যজনক ব্যাপার, ওই সময়ে ওটা ওয়াল পেপারে হতো। ছাত্ররা লিখত। কবিতা, হ্যান্ড রাইটিং-এ প্রকাশ হতো।

মৈশান: অনেকটা দেয়াল পত্রিকার মতো...

মনির: হ্যাঁ, দেয়াল পত্রিকার মতো। দেয়ালের বোর্ডে পেস্ট করত। তারপর এটা ইজেলেও রাখত। যেহেতু ওটাতে কবিতা ছিল, গল্প ছিল আরও অনেক কিছু। সেখানে আমার একটা কাজ ছিলশিরোনাম আঁকা। পাশে রিকশার দোকান ছিল। সেখানে রিকশা বানানো হতো। সেখানে তারা আমাকে রিকশার বডিতে আঁকার প্রস্তাব দিল। আমি তো কখনো রিকশার বডিতে আঁকি নাই। তখন ওই বডিতে আঁকার একটা সুযোগ পেলাম। বডি তো একটা বিরাট স্পেস। সেখানে আঁকলাম সিনেমার দৃশ্যমিনা কুমারী বীনা নিয়ে বসে আছেন এমন একটা দৃশ্য। আমার মনে হলো, হয়তো কোনো দিন আমি সিনেমার ব্যানার আঁকতে পারব। বিরাট কিছু শিখব।

শিল্পী মনিরুল ইসলাম: ছবি: নাসির আলী মামুন © ফটোজিয়াম

মৈশান: তখন ওই রকমই একটা স্বপ্ন ছিল আপনার...

মনির: স্বপ্নটা... এ রকম দেখতাম, যখন সিনেমা বদলাত, তখন নতুন নতুন ব্যানারও বদলাতে হতো। অনেক সুন্দর সুন্দর ব্যানার। তখন থেকে একটা আত্মবিশ্বাস জন্মে, আমি সিনেমার বড় ব্যানারে আঁকতে পারব। এ রকম একটা স্বপ্ন ছিল। অনেক সিনেমা চলত, মাসে মাসে নতুন নতুন ব্যানার করতে হতো। সপ্তাহ বা পনেরো দিন পর পর প্রচুর ব্যানার বদলাত। বড় বড় ব্যানার দাঁড় করিয়ে রাখত। আমি ভাবতাম কী করে সম্ভব, এত বড় বড় তারা পোর্টেট আঁকে! এত দিন পড়ে আমি বিশ্লেষণ করে দেখলাম, দে আর রিয়েলি ভেরি গুড। দে আর অল ক্রিয়েটিভস। আমার তখন লেখাপড়ায় খুব মন বসত না, মানে যেখানেই ছবি হতো সেখানেই আমি লেগে থাকলাম।

টিপু: স্কুলের নাম কী?

মনির: রামাদাস হাই স্কুল। ওই স্কুলটা কিন্তু, তখনকার হিসেবে খুব অগ্রসর ছিল। মানে স্কুলের নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের ভার পড়ত আমার ওপর। লেখাপড়া কিছু করতাম না। কিন্তু যা আঁকার আদেশ পেতাম, তা আনন্দের সঙ্গে করতে লাগলাম। এমনিই করতাম। তখন কোনো পারিশ্রমিক ছিল না। আমাদের পরিবারে কোনো শিল্পী ছিল না। নাটক, সাহিত্য, নাচ বা গানকোনো কিছুতেই নাই। ফলে বাবা আমার ওপর খুব অসন্তুষ্ট। কারণ তারা মনে করতেন, ঢাকাতে বড় বড় সাইনবোর্ড লিখবে, সেই সাথে এটা-ওটা আঁকাআঁকি করবে, বড়জোর রিকশা পেইন্টিং করবে। শিল্পী বলতে তো তখন কোনো কিছু জানা ছিল না তাদের।

মৈশান: এই ছিল আপনার বাবার দৃষ্টিভঙ্গি, মানে বাবাদের...

মনির: হ্যাঁ, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও তাই। তার ওপর মুসলিম রক্ষণশীল তারা। তাদের মত ছিল, এসব আঁকাআঁকি শিখে সে করবেটা কী! বরং বিদ্যুৎমিস্ত্রী হওয়াই ভালো। ছেলে যখন কিছুই হবে না, তাই কারিগরি কিছু শিখুক। আর এদিকে আমার ম্যাট্রিকেও ড্রপ করতে হলো। তিনবার ড্রপ গেছে। আমি ম্যাট্রিক দিয়েছি ৬৮ সালে। ম্যাট্রিক পাস করার পরে কলেজে ভর্তি হই। তারপর বিএ ক্লাসে এক বছর ড্রপ দিয়েছি। বাবা অবসর গ্রহণের পরে চাঁদপুরে চলে আসি। চাঁদপুর যদিও নিজের জেলা, তারপরও এই প্রথম এলাম। ২৪ বছর বয়সে এই প্রথম নিজের শহরে আসি।

তোমার বাড়ি কোথায়, নরসিংদী নাকি [মৈশানকে উদ্দেশ করে]...

মৈশান: ব্রাহ্মণবাড়িয়া...

মনিরুল: ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হ্যাঁ, তা ওই আমাদের কাছাকাছিই।

চাঁদপুর আসি ৬১ সালে। চিন্তা করলাম ঢাকায় আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু এখানে তো ম্যাট্রিক পাস না দেখাতে পারলে ভর্তি করে না। কী করি, পড়লাম ফ্যাসাদে। এটা আমার শেষ সুযোগ। আমার সতীর্থ ছিল শামসুল ওয়ারেস, এখন স্থাপত্যবিদ। আমি কিন্তু ওকে পেয়েছি ক্লাস টেনে, চাঁদপুরে। চাঁদপুরেই আমি ম্যাট্রিকে ভর্তি হই। সেখানে ওয়ারেস আমাকে খুব সাহায্য করে। অঙ্কে তো আমি খুবই কাঁচা। সে খুবই ভালো ছাত্র ছিল। এখন বোঝা যায়, সে একজন ভালো শিক্ষক। তার যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-যুক্তি, তখন থেকেই বোঝা যেত। তখন প্রিটেস্ট পরীক্ষায় একটা রচনা আসে

বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য। কারোই যখন পড়া নাই, আমি আরম্ভ করলাম লেখা। কিন্তু এই একটা লেখাতেই আমার তিন ঘণ্টা চলে গেল। আমাদের পণ্ডিত স্যার দেখে তো সারপ্রাইজ! রচনা যেভাবে হয়, সেভাবে লিখিনি আমি। আমি বর্ণনা দিয়েছি, বিকাল বেলাটা কী রকম হয়, সূর্য ডোবার সময় আলো ধোঁয়াশা হয়ে যায়, ওই সময় গরু যায়, গরুগুলো দেখা যাচ্ছে আবছা, বাচ্চাগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ছে, নদীর ঘাটে বসে ভিজুয়ালি এই দৃশ্যগুলো বর্ণনা করা হচ্ছে। এখন বুঝি যে এগুলো একটু প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করলে আসে, না হলে আসে না। যাই হোক, ৬৮ সালে পাস করলাম।

টিপু: আপনি আর্ট কলেজে আসলেন কোথা থেকে?

মনির: ওই যে বললাম না, ম্যাট্রিক পাস করার পর। আসলে ওটা ছাড়া আমার অন্য কিছু করার ছিল না। নো সেকেন্ড অপশন! শিল্পী হবো কি না জানি না, তবে আমাকে ছবি আঁকতে হবেএটাই ছিল আমার সিদ্ধান্ত। ছবি আঁকলেই যে শিল্পী হয়, ওই রকম কিছু আমার মাথাতেই ছিল না। এখন এত বছর পর বুঝিঅল আর্টিস্ট ইজ নট আর্টিস্ট!

মোস্তফা: জীবনানন্দ দাশ যেমন মনে করতেন—‘সব কবি কবি নয়...

মনির: হুম, আসলেই তাই। সহজভাবেই বলছি, এই আর্ট কলেজের একটা সার্টিফিকেট হয়ে গেলেই কি শিল্পী হয়ে গেল এবং ভালো করলেও... যদিও ভালোর মানদণ্ডটা আপেক্ষিক...

মৈশান: তাহলে শিল্পী কে?

মনির: শিল্পী শব্দটা একটা সৃষ্টিশীলতার ব্যাপার। যেটা আমার মনে হয়, যতক্ষণ একজন শিল্পী একটা নিজের জগৎ বা অন্তর্গত বিশ্ব তৈরি করতে না পারে, ততক্ষণ সে শিল্পী হতে পারে না, জটিল বা সহজ যা-ই বলি না কেন! এখন তো পঞ্চাশ বছর পর, অনেক নতুন বিষয়-আশয় হয়ে গেছে। আগে এগুলো তো ছিল না। এখন ঢুকে গেছে নিউ মিডিয়া। এই যে কম্পিউটারটা ঠিক প্রেসের মতো, ইলেকট্রনিক প্রেসের মতো, আমার তো প্লেট করতে হবে, প্লেট না করলে তো প্রিন্ট মেকিং হবে না। তার মধ্যে সৎ হওয়া দরকার কাজে ও চিন্তায়। শিল্পটা আবার বুদ্ধিবৃত্তির ভিতর ঢুকে গেছে। সবশিল্পী তো আর বুদ্ধিবৃত্তিক না, আবেগ দিয়েও কাজ করছে অনেকে। শুধু আবেগী হলেই হবে না, হয়ে উঠতে হবে বুদ্ধিময়। ছমাস বদ্ধ ঘরে বসে ছবি আঁকতে হবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। শিল্পীদের রাজনীতি, সমাজ, ভূগোল, দৃশ্যশিল্পবুঝতে হবে অনেক কিছুই।

আমরা শুরুর দিকে আঠারো-উনিশ শতকের শিল্পকলা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। কারণ হয় কি, এখানকার বাংলাদেশ থেকে শিল্পীরা দেশের বাইরে গেলে মিউজিয়ামের বড় গ্যালারিতে ঢুকতে চায় না। করপোরেট গ্যালারি, ভয় লাগে ঢুকতে। সুতরাং এই ভয় ভাঙতে অনেক সময় দরকার। বড় স্টুডিওতে গিয়ে, বড় শিল্পীদের সাথে আলাপ করতেই ভয় লাগে। সে কী না কী মনে করে, এই একটা কমপ্লেক্স থাকে। কিন্তু শেষ নাগাদ এটা যদি একবার ভেঙে যায়, তবে অনেক দূর আগানো সম্ভব।

মোস্তফা: আপনি যেটা বলছেন সাহসের ব্যাপার আরকি! ছবি আঁকতে গিয়ে কি সাহস লাগে?

মনির: অবশ্যই সাহস লাগে।

মোস্তফা: আপনি শুরু কীভাবে করলেন?

মনির: শুরুতেই আমার অনেক বছর চলে গেছে। এই সময়ে যারা শিল্পী হচ্ছেন, তাদের একটা প্রবণতা হচ্ছে, তারা বিমূর্ত ছবি আঁকছেন, ভেঙেচুড়ে করছেন। আমাদের সময়ে ব্যাপারটা কিছুটা অসম্ভব ছিল। কারণ শিক্ষকরাই দেখেন নাই বিমূর্ত ছবি। দু-একজন এঁকেছেন প্রথম প্রদর্শনীতে ওই রকম কিছু ছবি। কামরুল হাসান, দেবদাস চক্রবর্তী, মূর্তজা বশীররা আরম্ভ করলেন এটা।

মোস্তফা: এটা কোন সময়ের ঘটনা?

মনির: সেটা হবে ৬৩ সালের দিকে। তখন কিছু শিল্পী ছিলেন প্রগতিশীল মানসিকতার। কেউ কেউ এর বিরোধিতা করলেন, মানে আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে। মানে শক্ত আন্দোলন, তালা ভাঙবে, মিছিল বের করবেএ রকম প্রবণতা ছিল আরকি। তো আমি বলছি যে সাহস অবশ্যই দরকার, সাহস এই হিসেবে এক জিনিস, নিজের ছবি নিজেই ধ্বংস করা দরকার আরেক জিনিস। আমাকে একজন বিদেশি শিল্পী বলেছেন, নো ডেসট্রাকশন নো ক্রিয়েশন...

মৈশান: ডেসট্রাকশন কোন অর্থে, ফিজিক্যালি ছবি পুড়িয়ে দেয়া?

মনির: না, অনেক প্রসেসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। আমি পোড়াই না, আবার ছিঁড়ে ফেলিও না। এটা মানেই ডেসট্রয় নয়। আবার কেউ পুড়িয়ে দিলে তো, তা শেষ হয়ে গেল না। অনেক শিল্পীই তো নিজের ছবি নিজে পুড়িয়েছেন।

মোস্তফা: ফ্রান্সিস বেকন...

মনির: হুম। তারপর একটা মানসিক যন্ত্রণা হয়। এটার দুটো কারণ হতে পারে, একটা হলো সে যা চায়, তা পাচ্ছে না। এটা স্নায়বিক চাপ, ভয়, চিন্তাসবকিছু মিলিয়ে তার যে যন্ত্রণা, সেটা। আরেকটা সিম্বলিক হিসেবে দেখছে যে পুড়িয়ে দেখি না, কী হয়।

মোস্তফা: ইরেজ করে দেওয়া, স্মৃতি থেকে মুছে দেওয়া...

মনির: হ্যাঁ, এটা ভিতরে থাকে তো। হয়তো এটা মানসিকভাবে ভিতরে তাকে প্রভাবিত করবে।

মোস্তফা: হয়তো দেখা যাবে, এটাই তাকে আরও বেশি শক্তি দেয়

মনির: হ্যাঁ, শক্তিও দেয়। এটা হিন্দুদের দুর্গাপূজায় দেখা যায়। কত অর্থ খরচ করে তা বানায়, তারপর সেটাই বিসর্জন দিয়ে দেয়। পরের দিন থেকে কুমাররা লেগে যায়। এদের কাজই তো এটা। এটা একটা সিম্বলিক ব্যাপার। এটা ইউরোপেও আছে। যদিও অনেকে পারে না নিজের কাজ নষ্ট করতে। কারণ, নিজের ছবি নষ্ট করা কঠিন। নষ্ট করা মানে আমি আবার বদলিয়ে করি। আরও কীভাবে করা যায়! হয় কি, ছবিটা তো আমার কাছে খালি হোল্ডিং দ্য টাইম বেয়ন্ড দ্য মোমেন্ট। যে সময়টা নিয়ে আমি কাজ করছি, তার রিফ্লেকশনটা যেন আমার ক্যানভাসে বা কাগজে থাকুক। আমি মনে করি, এক দিনেই আমি ছবিটা শেষ করতে পারি যেটা ভাল, সুন্দর এবং পরিষ্কার। কিন্তু পরের দিন তো আর এটা নিয়া চিন্তা করছি না। মানে নানা সময়ে নানা ব্যক্তিত্বে রূপান্তর হয়।

মৈশান: সময় তো খুবই নির্দিষ্ট। সময় ও স্থানিকতার সাথে শরীর তো প্রকৃতিগতভাবেই আছে...

মনির: না বোধ হয়, এটা সময়কে ধরা। জয়নুল আবেদিন দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেছেন ৪৩ সালে। তিনি হয়তো জানতেন না, এটা নেবে কি নেবে না। তবে এটার দরকার ছিল ওই সময়ের জন্য।

মৈশান: ওটায় তো একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল। ওটা তো পার হয়ে গেছে?

মনির: কিন্তু শিল্পকর্ম হিসেবে বললে ওই মুহূর্তটার যে ঐতিহাসিক মূল্য, ৪৩ সালে মানুষ কী রকম সময় পার করছিল, তার হিসেবে দৃষ্টান্তমূলক শিল্প হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। আবার ধরো, মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে, সবাই যে যেমন পারছে আঁকছে, লেখকরা লিখছে, কবি কবিতা লিখছে, সিনেমা বানাচ্ছে, যে যেমনে পারছে তা নিয়ে আসছে। কারও না কারও অবদান আছে। এখন তো ৪১ বছর পার হয়ে গেছে, এখন আবার কিসের মুক্তিযুদ্ধের ছবি! আবার ব্যতিক্রমও আছে। যেমনলিও তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস অনেক বছর পর লিখেছেন, যে জন্য সেটা একটা মাস্টারপিস হয়ে উঠেছে, কিন্তু এ রকম কীর্তি অভাবনীয়। কিন্তু দুনিয়াজুড়ে মানুষ চাইছে নতুন চিত্র, নতুন জিনিস, নতুন কিছু। তবে শিল্পের ব্যাপারে আমাদের মাথায় কতগুলো জিনিস থাকে। এগুলো মুছে ফেলা খুব মুশকিল। রেমব্রান্ট আমার প্রিয় শিল্পী এখন পর্যন্ত। রেমব্রান্ট ইজ ভেরি পাওয়ারফুল। আবেদিন স্যারও! উনি খার ইউজ করতেন, রেমব্রান্ট ইউজ করতেন ব্রাশ। তিনি নিজেই বলতেন যে রেমব্রান্টের এই জিনিসগুলো অত্যন্ত সুন্দর। রেমব্রান্ট একমাত্র শিল্পী, যিনি তার দুইটানে এঁকেছেন নিষ্পাপ শিশুর মুখ। ক্যানভাসে যেন বাচ্চা কাঁপছে, মায়াময়। ক্যানভাস থেকে যেন এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে। এ রকম গয়্যার ছিল ফ্রেন্স রেভিউল্যুশনের ওপর এচিং। গয়্যা যখন ডেডবডি আনে ক্যানভাসে, দেখা যায় কীভাবে টর্চার করছে ফরাসিরা। এমন ছবি আঁকছে সে সময়, এটা একটা বিরাট রেভিউল্যুশন ছিল।

মৈশান: আপনি বলেছিলেন জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের ছবি নিয়ে। এটাতে বিশেষ সময়ের সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতা আছে। এমনিতে আপনার যে ছবি বা শিল্পকর্ম বাংলাদেশের সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে কীভাবে সম্পর্কিত?

মনির: আমি তো যুদ্ধের সময় স্পেনে ছিলাম। এচিংয়ে কাজ করেছিলাম। বলি না একেকজনের একেকটা রঙের ব্যাপার থাকে। গয়্যার কতগুলো শিল্পকর্ম আছে। কালোর মধ্যে হলুদ আভা, সাদার মধ্যে কালোয় আঁকা।

টিপু: আপনার পুরোনো ছবিগুলো কি রিয়েলিস্টিক ছিল?

মনির: না। তখন মিশ্র মাধ্যমে করেছি আমি। এর দুই বছর পরে হঠাৎ করে নৌকা আঁকি। আমি কোনটা আনবো, এটা নির্দিষ্ট কিছু না।

মৈশান: অবয়বধর্মী...

মনির: অবয়বধর্মী না। প্রত্যেক শিল্পীর কোমল একটা সময় আসে। একটু ওরিয়েন্টাল আরকি! তার ড্রয়িং, ড্রয়িং না, রংগুলো একটু অর্নামেন্টাল। হ্যাঁ, ছোট ছোট ছবি, কোনো দিন বড় ছবি আঁকি নাই।

মৈশান: আমরা বলছিলাম বাংলাদেশের বাস্তবতার সাথে আপনার শিল্প কীভাবে সম্পর্কিত?

মনির: এই সম্পর্কটাই তো আমি বলছি, ওটা বলতে হবে, সরাসরি আমার কোনো সম্পর্ক নাই। তবে সরাসরি যদি বলি, নারী, যেটা ভিজ্যুয়ালি ইমেজ, ইমেজ ভেরি স্ট্রং। প্রথমে বলব, আমি এখন পর্যন্ত বন্ধ জায়গায় অন্ধকার ছবি আঁকি না। আমি চাই খোলা ক্যানভাস। খোলা জায়গা। যেমন আকাশ দেখা আমার ছিল শখ, শরতের মেঘ। এ রকম, মেঘনা নদীর ছবি। তো এই হিসেবে মেঘনা আমার কাছে বিরাট একটা গ্রেট স্পেস...

মোস্তফা: আপনি যে সত্তরের কাজের কথা বললেন, ওটায় তো ডার্ক ছিল, বাংলাদেশের বাস্তবতা পুরো বোঝা যেত...

মনির: হ্যাঁ তখন কিছু ইমেজ ছিল, কিন্তু ওটা আমার কাছে খুব একটা ট্রাপের ব্যাপার। অ্যাবস্ট্রাক্ট উইথ ইমেজ ইজ এ সাসপেন্সেস ওয়ার্ক। এটা খুব কঠিন সিরিজ। বিমূর্ত শিল্প আবার অবয়ব নিয়ে করা খুব কঠিন কাজ। বিশেষ করে স্পেনে, স্পেনের শিল্পীরা কোমল ও উজ্জ্বল টোনে কাজ করে। ওদের জীবনটাই অন্য রকম। ওদের স্লোগান খুব রাজনৈতিকঅ্যানার্কিজম জিন্দাবাদ, ব্রেড অ্যান্ড ওম্যান নাথিং এলস। এখন পর্যন্ত এটাই ওদের স্লোগান। অনেক সময় আমি বলছি, তিন ধরনের চরিত্র বেশ ইন্টেরেস্টিংব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদী, আবেগপ্রবণ ও নৈরাজ্যবাদী।

মৈশান: আপনিও কি নৈরাজ্যবাদী?

মনির: না, না। আমি কোনো নৈরাজ্যবাদী দলকে সমর্থন করি না। কারণ শুধু পলিটিক্যালি ব্রেড অ্যান্ড ওমেন হলেই তো হবে না, আরও অনেক কিছুরই দরকার হয়। জাস্ট ফলো দ্যান ইউ গো...

মোস্তফা: গয়্যার একটা প্রভাব আছে...

মনির: কার ওপর?

মোস্তফা: ওই পিকাসোর

মনির: শিওর, শিওর... দাঁড়াও, আমি কী যেন বলতে চেয়েছিলাম...

মোস্তফা: শিল্পীদের একটা রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে পারে, এটা নিয়ে আপনি কি ভাবেন? অনেক শিল্পী দেখা যায়, রাজনৈতিক বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকেন। যেমন শিশির ভট্টাচার্য্যের ছবিতে দেখা যায়।

মনির: আমি এইগুলো দেখেছি। তো আমার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছিফ্রাঙ্কোর শাসনকাল তো আমি স্পেনে পেয়েছিলাম পুরাই। সতেরো-আঠারো বছর ফ্রাঙ্কো ক্ষমতায় ছিল একদম মারা যাওয়া পর্যন্ত। তখন চিত্রশিল্পী ছিল রাফায়েল...ক্যানাবেসরা, তারা এখনো বেঁচে আছেন। তারা কথা বলতে পারতেন না। সেখানে দমন চলছে, মত প্রকাশের কোনো স্বাধীনতা নাই। তখন একমাত্র শিল্পীরা ছবি দিয়ে প্রতিবাদ করতে পারে। নৈঃশব্দ্যকে অবলম্বন করে তারা ছবি আঁকতেনজিঞ্জির পরা, বুটস, হ্যাট। ওরা তো সরাসরি রাজনৈতিক ছবি আঁকত না? যেমন ক্যানাবেসের ছবি ছিল মানুষ একটা স্কয়ারে শুধু শুধু দৌড়াদৌড়ি করছে, স্কেটারে করে। খুব নামকরা ওই ছবি। তারপর দেখলাম কি, ফ্রাঙ্কো মারা যাওয়ার পর ওই ছবি কেউ আর চায় না। কিন্তু বলতে হবে ফ্রাঙ্কোর সময়ে তারাই শ্রেষ্ঠ শিল্পী। আমি বলছি যে শিল্পীদের একটা দায় আছে। শিল্পীদের উচিত ঠিক সময়ে অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করা বা প্রতিবাদে সম্পৃক্ত হওয়া। হ্যাঁ, এখন আমাদের দেশের সিচুয়েশনে আমি জানি না যে প্রচার মাধ্যম কতটা মুক্ত বা কতটুকু স্বাধীন। যেমন স্পেনে, যিনি শাসনক্ষমতায় বর্তমান আছেন তাকে যদি পাঁচ মিনিট সময় দেয়া হয়, বিরোধীকেও দিতে হবে পাঁচ মিনিট, ছয় মিনিট না। মানে গণতন্ত্রের জন্য এগুলো মেনে চলতে হবে।

মৈশান: তাহলে কি শিল্পীর কাছে ইতিহাসের কোনো মূল্য নাই?

মনির: না, আমি তা মনে করি না। শিল্পী তো অনেক ধরনের। যেমন স্থানিক বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন, ছবি আঁকছেন, যেমন জনগণের জন্য কী করছেন, কী ভাবছেন এই সব। কিন্তু একজন শিল্পী পাঁচ বছর ছবি এঁকে জনগণের জন্য বসে থাকে না। তার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর বাড়ছে, ভিজ্যুয়ালি, কনসেপচুয়ালি অনেক বিষয়-আশয় আসছে, আস্তে আস্তে সে ছবি আঁকতে চায়, এগুলোই ইউনিভার্সাল ওয়েতে সমান আনন্দ পায়। এখন যে আমি রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখছি, তা তো খুবই অগ্রসর, এবং আধুনিক প্রবণতার। ইউরোপে এখনো এই ধরনের ছবি আঁকা হয়। এই ছবি, যে ঘটনা বা ইমেজ বা রং হোক, রেখা হোক, এটা যদি সর্বজনীন স্বীকৃত হয় বা ছবির স্বাদ পায়, তখন আমি নিজেই মনে করব যে, ওয়েল।

শিল্পী মনিরুল ইসলাম: ছবি: নাসির আলী মামুন © ফটোজিয়াম

টিপু: আপনার কাছে এই নন্দনতত্ত্ব জিনিসটা কী? যেমন আপনি কি ছবিতে এক প্রকার সৌন্দর্য সৃষ্টি করে আনন্দ পান...

মনির: সুন্দরের তো খাঁটি কোনো সংজ্ঞা নাই। সুন্দর কী? আগের শিল্পীরা মডেল আঁকত। কিন্তু মডেল তো ফিফটিন, সেভেন্টিন সেঞ্চুরির ছবি, যেগুলো মিউজিয়াম আছে, প্রাগো আছে, লুভা আছে। মানুষের দেহের অনুবাদ ঠিক এ রকম হয় না। শিল্পীরা তা যোগ করতেন ওই বাস্তবতা থেকে, যা আছে এর থেকে অন্য কিছু। মানে মানুষ আরও সুন্দর হতে পারে। কারণ শিল্পীর তুলিতে একটা ব্যাঙের চামড়া গোলাপ থেকে সুন্দর হতে পারে। সুতরাং সুন্দরের যে কোনো সংজ্ঞা নেই, এটাই সুন্দর। এই যে অনেক সময় বলেট্রুথ ইজ বিউটি, বিউটি ইজ ট্রুথএটা হলো একটা স্লোগান মাত্র।

মৈশান: আপনার ছবিতে একধরনের বিউটি আছে, মানে...

মনির: একেক শিল্পীর ধরন একেক। একধরনের ক্র্যাক, টেনশন, নার্ভাস, ছবিটা কাইন্ড আর্ট না। মায়াবী ধরন আছে একটা, সুন্দর রং, যেগুলো মানুষকে বিরক্ত করে না। দেখলে রাগ না হয়, অস্বস্তি না করে, যেগুলোর রং আছে, রঙের মিশ্রণ আছেঅনেক ধরনের আছে তো। আবার অনেক ছবি আছে, অনেক শিল্পী আছেন যারা স্নায়ুর চাপ ও চিন্তা নিয়ে আঁকেন। যেমন জ্যাকসন পোলকের ছবি দেখলেই বোঝা যায়, এই ছবি স্নায়বিক চিন্তা নিয়ে আঁকা। কিবরিয়া স্যারের ছবি খুব শীতল, ভেরি স্লো...

মৈশান: মোহাম্মদ কিবরিয়ার শিল্প খুবই ফর্মালিস্ট এবং এলিটিস্ট ধরনের। এটার সাথে আপনার শিল্পকর্মের কোনো সম্পর্ক আছে কি কিংবা আপনার স্বাতন্ত্র্যটা কোথায়?

মনির: না, স্বাতন্ত্র্য আছেই। স্বাতন্ত্র্যের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, উনি ফ্ল্যাট রং ইউজ করতেন। ওনার সাথে অনেক আলাপ হতো। তবে তিনি ওনার আর্ট নিয়ে আলোচনা পছন্দ করতেন না। তাই আমিও করতাম না। তিনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন। অনেক সময় ব্যক্তি আর শিল্প মিলে যায়। ব্যক্তিত্ব ও তার কথা, আচরণ, মানুষ এবং ছবি কাছাকাছি যায়। আবার কিছু কিছু সময় দেখা যায়, মানুষ রহস্যবাদী। দেখা যায় মানুষ এত রূঢ় কিন্তু সুন্দর ছবি আঁকছে কী করে। এগুলো বিতর্কিত ব্যাপার। তো আমি বলব, কিবরিয়া স্যার, নিজের একটা পথ সৃষ্টি করছেন। তিনি একই গতিতে ছবি এঁকে গেছেন। এখানে অন্য কারও সাথে তুলনা করলে হবে না। আমি প্রথমেই বললাম যে একটা শিল্পী যতক্ষণ না নিজের একটা জগৎ তৈরি করতে না পারেন, ততক্ষণ তিনি শিল্পী নন। এটা খুবই কঠিন... এটা সবাই পারলে তো সবাই শিল্পী হয়ে বেরুত। তাই না?

টিপু: শিল্পীর অন্তর্গত জগৎটা কী?

মনির: অন্তর্গত জগৎ বলতে বুঝব, একজন শিল্পী যে চিত্র সৃষ্টি করছে এর ভিতর গভীরতা বা স্তর ও তার চিন্তা। এবং সে ছবি দেখেই বোঝা যায় যে এটা তার ছবি। সে অবয়বধর্মী বা বিমূর্ত যাই হোক না কেন! যেমন পিকাসো, সকালে পোর্ট্রেট আঁকছে, বিকালে বুলফাইটের ছবি, রাতে কিউবিজম করছে, এক দিনেই তিন রকমের ছবি। কিন্তু তার স্বাক্ষর ছাড়াই ছবি বা ড্রয়িং দেখলে বলে দেয়া যায়, এটা পিকাসোর ছবি।

মৈশান: আপনি বলতে চাচ্ছেন, এতে তার একটা চিহ্ন তৈরি করে?

মনির: না, চিহ্ন না। আই ডোন্ট লাইক ট্রেড মার্ক! কী বলে এটা, একটা লোগো তৈয়ার করে, যেটা হলো শৈলী।

মোস্তফা: কিন্তু একটা ধারাবাহিকতা তো থাকতে হয়। যেমন আপনার একেবারে প্রথম দিককার কাজ... খুব চেনা যায় এ রকম একটা...

মনির: উম্... কিন্তু তখন তো আমি ক্যানভাসে লেখতাম অনেক কিছু। সামঞ্জস্যপূর্ণ চিহ্ন আকারে। কারণ আমি যখন লেখি না, চিন্তা করলাম, এটার একটা ট্রিকি ব্যাপারও আছে। ক্যানভাস দখল করা, চোখের সৌন্দর্য সৃষ্টি করা...তাই না! তো আমি লেখছি, লেখা দরকার তাই। এটাকে ড্রয়িংয়ের একটা অংশ বলা যায়। এটা দেখতে সুন্দর। কিন্তু পরে আমার কাছে এটাই ফেইক মনে হয়েছে।

মোস্তফা: ক্যালিওগ্রাফির সাথে যে বিমূর্ততা, কিবরিয়া স্যার কিন্তু ওটার সাথে কখনোই ছিলেন না। আপনার তো শুরুর দিকে ক্যালিগ্রাফির দিকে ঝোঁক ছিল, আপনার ছবির বিমূর্ততার যে রিদম, টিপু আপনার ছবি সম্পর্কে যেটা বলল রিদম, এই রিদমটা ক্যালিগ্রাফির রিদম বলা যায়?

মনির: ক্যালিগ্রাফি তো নৃতত্ত্বের ব্যাপার। তবে তাঁর চিন্তা ও দর্শনটা বুড্ডিস্ট ধরনের। তার শুরুটা সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন চায়নিজ ক্যালিগ্রাফি থেকে। শুরুতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি কিছুটা প্রভাবিত ছিলেন।

আমি বলছি যে, হয় কী, বাংলাদেশের আর্টের যেটা, এক রকমের শুরু হয়ে গেলে সবাই সেটাই করতে থাকে। ইউরোপীয় প্রবণতা হলো টেক্সচার... আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু মোজাইক পেইন্টিং, এটা এখন ইউজলেস। কারণ ইউরোপীয় মানসিকতার এই প্রবণতা কিন্তু আরেকটা কারুদক্ষতায় চলে যায়। এখানে শিল্পের একটা আত্মা থাকে এই পর্যন্ত। তারপরে ইমেজকে রং দিয়ে ঢেকে দিলে শিল্প থেকে কারুদক্ষতায় চলে যায়। কারণ একটা সুন্দর ম্যাট বানানো শিল্পীর কাজ না। এটা খুব পরিষ্কার কারুকাজ। আগেও আমি অনেকবার বলছিলাম, পশ্চিমা শিল্পীরা এটাকে বলে কারি পেইন্টিং। যা-ই বলো, গোলকায়নের যুগে শিল্পের কোনো সীমারেখা নাই।

টিপু: আপনার ভাষা কি সর্বজনীন?

মনির: না, ইউনিভার্সাল হলেও পুরা আমি তো আমার মতো

টিপু: আপনার শিল্পে রেখা তো স্পষ্ট থাকে ক্যানভাসের মধ্যে..

মনির: একেক ছবি কিন্তু একেক জগতের। ছবি তো ভিন্ন একটা জিনিস চায়। আমি যদি রেখার উপর কাজ করি, খালি রং গুলিয়ে দিলে হবে না। কিছু শূন্যতার ভেতর ড্রয়িংগুলো একই থাকবে। আবার যদি বেশি রঙে কাজ করি, সেখানেও ভাগ করে নিতে হবে। ছবির নতুন মাত্রা সৃষ্টি করতে গেলে রংও বাড়ানো যায়, লাইনও বাড়ানো যায়, সবকিছুই বাড়ানো যায়। কিন্তু ছবি আঁকার আগে যে ভিজ্যুয়ালাইজেশন, যে ছবিটা কী হবে, এটা আমি জানি না। ছবিটা শেষ হবার আগে বলা যায় যে ছবি কেমন হবে! কোনো শিল্পীর পক্ষে অসম্ভব।

টিপু: এটা একটা ইউটোপিয়ার মতো, আপনি একটা কল্পনার জগৎ গড়ে তোলেন, ওটা হচ্ছে আপনার রেখা এবং টেক্সচারের মধ্যে দেখা যায়, মাঝেমধ্যে দেখা যায় রেখাটা ক্যানভাসের বাইরে চলে যাচ্ছে...

মনির: রেখার তো অনেক রকম অর্থ আছে। ভাঙা রেখা আছে, আবছা রেখা আছে, আলোকে ফোকাস করার রেখা আছে। রেখারও সৌন্দর্য আছে। অনেক সময়, ভাঙা রেখা ক্যানভাসে ভাঙা ভাঙা অর্থ নিয়ে খেলছে। অনেক সময় আমরা ছবিতে রেখাটা মুছে দিচ্ছি। কারণ আবছা রেখারও একটা মজা আছে। তাই না!

মৈশান: আপনার কাজে একটা অনানুষ্ঠানিতার ব্যাপার আছে। তবুও শেষ পর্যন্ত তা আনুষ্ঠানিকই মনে হয়। এই বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখেন?

মনির: সেটার মধ্য দিয়েই তো আমি যেতে চাচ্ছি। এটার জন্য আমি বেঁচে আছি। শিল্প তো অনানুষ্ঠানিক হয়।

মৈশান: আনুষ্ঠানিকই লাগে, আপনার এই কাজ বিন্যস্ত মনে হয়...

মনির: বিন্যস্ত, জন্মসূত্রে বোধ হয় আমি বাঙালি। মানে শেষটা অসমাপ্ত রেখে কীভাবে ছবি শেষ করব? কীভাবে শেষ করতে হবে এটা তো আগে থেকে নির্ধারণ করা যায় না। যেকোনো শিল্পীর পক্ষেই সেটা অসম্ভব।

মোস্তফা: এটা তো একটা স্কুলিং থেকে আসা। আপনার কি মনে হয় ব্রিটিশ স্কুলিংটাই আমাদের ক্ষতি করে গেছে?

মনির: আমার তো মনে হয়, একটা না একটা কাঠামোর ভিতর দিয়েই আমাদের আসতে হবে। তো চারুকলা কলেজে কিছু টেকনিক ছাড়া অন্য কিছু শিখাতে পারবে না। এখন আমি তো বুঝি, ছবি আঁকার টেকনিক শেখার জন্য পাঁচ বছর কোর্সেরই কোনো দরকার নাই। আর ছবি আঁকা, গল্প লেখা, কবিতা লেখা, এইগুলো তো কোনো দিন কোনো প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে দিতে পারে না।

মৈশান: আপনার কাজের মধ্যে অন্তর্গত জগৎ যেমন আছে, পাশাপাশি বাহ্যিক দুনিয়ার কিছু চিহ্ন যুক্ত থাকে, এই জিনিসগুলো কী?

মনির: এটা হলো তোমার ওই, মানুষ তো জন্মগতভাবে কোনো কিছু নিয়ে আসে না। তবে শিল্পীরা জন্মগতভাবে কিছু জিনিস নিয়ে আসে। স্প্যানিশ শিল্পীরাও এমন মনে করেন।

ধরো, মানুষ তো সব একই মগজ নিয়ে আসে। আইনস্টাইনের যা ছিল, একটা সাধারণ মানুষেরও ওই একই মাথা ছিল। অনেকেই ভুল পথে যায়, কিন্তু আইনস্টাইনের মগজ সঠিক পথে গেছে।

টিপু: একটা জিনিস, আপনার ছবিতে কি অনুধ্যানের ব্যাপার আছে?

মনির: না, ক্যানভাসের সাদাংশটা আমার কাজে ঢুকে যায়। মেডিটেশন বা অনুধ্যানের ব্যাপারটা আমি বুঝি না। কেননা ওটা হলো স্পিরিচুয়াল। কিন্তু আমি বুঝি শূন্যতা, তাই ক্যানভাসে শূন্যতা সৃষ্টি হয়ে যায়।

মৈশান: তাহলে কি আপনি শূন্যতাকে সুন্দর মনে করেন?

মনির: অবশ্যই। আমার মনে হয়, শূন্যতা অনেক কিছু...

মৈশান: শূন্যতা কেন সুন্দর, এটা যদি আপনি বলেন...

মনির: পূর্ণতা ও শূন্যতা দুটো জিনিস। একটা হলো দৃশ্যের শূন্যতা, আরেকটা হলো জীবনের শূন্যতা। এবং শূন্যতায়ও তো গভীরতা থাকতে পারে।

টিপু: আপনি বলতে চাচ্ছেন, পেইন্টিং জিনিসটা তাহলে মনোজগতের অচেতনে চলে যাওয়া?

মনির: পেইন্টিং তো, আনকনসাসনেস বা অ্যাকসিডেন্টাল জিনিস, আমার কাছে এমনিতে ভালো লাগে। যেগুলো আনকনসাসনেসে হোক আবার অ্যাকসিডেন্টালি হোক অথবা কোনো মিরাকল বা অ্যাকটিভিটির ওপর দিয়ে যেগুলো সারপ্রাইজ দেয়, ওটাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদি ছবিতে সারপ্রাইজ কিছু না দেখায়, তখন সেটা খুব বিরক্তিকর।

মৈশান: তাহলে আপনার সৃষ্টির ভেতরের প্রক্রিয়াটা কী?

মনির: ভেতরের প্রক্রিয়াটা কী হবে, আমি তো একটা গল্প নিয়ে কাজ করছি না। যে সরাসরি বার্তা এই হবে। সেই হবে। সরাসরি বার্তা দেয়া ছবি তো বোরিং। ছবি তো আঁকি নিজের জন্যে।

মৈশান: শিল্পী হিসেবেও আপনার কোনো রাজনীতি নাই?

মনির: আমি রাজনীতিমনস্ক, কিন্তু আমি সরাসরি কোনো পার্টি করি না।

মৈশান: তাহলে আপনার শিল্পে কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা নাই এই সমাজের?

মনির: না। এই যে সমকালীন রাজনীতি, কী হচ্ছে না হচ্ছে এখন, আই ডোন্ট কেয়ার। এগুলোর পেছনে আমি থাকতে রাজি না। এটা আমার কাজ না।

মৈশান: রাজনীতিতে শিল্পীরা নিজেকে যুক্ত করতে পারবে কি না?

মনির: কেন নয়, অবশ্যই। যখন খুব বেশি অরাজকতা হয়, তখন তো এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই হবে। তো সে পর্যায়ে তো আমরা এখন নাই। তবে এমন পরিস্থিতি আসে, শিল্পীদেরও শঙ্কার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। আমি বলছি না শিল্পীরা জীবনবিমুখ। একটা সময় তো লেখক-শিল্পীদের আদর্শিক পরিচয় নিতে হয়। আমি তো বাংলাদেশে আছি। হাঁটছি, দেখছি, বেড়াচ্ছি, এগুলো তো আমার শিল্পে কোনো না কোনোভাবে আসছে। আমার মা মারা গেছেন গত বছর। এটার একটা প্রভাব থাকে। মৃত্যুটা হচ্ছে শেষ ভ্রমণ। তো এই জিনিসগুলোর ভেতরেই আমাদের সংক্ষিপ্ত জীবন।

মৈশান: আপনার ছবিতে স্মৃতি বা নস্টালজিয়া মুখ্য বিষয় কি না? সে ক্ষেত্রে স্মৃতি আসলে কী ধারণ করে?

মনির: স্মৃতি আছে আমার বহু ছবিতে। জীবনের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসছে। কিছু জিনিস মানুষের স্মৃতিতেই থাকে। কিছু স্মতি আছে মানুষ কাউকে শেয়ার করে না। কিছু স্মৃতি আমি সব সময় ধরে রাখতে চাই। কথায় বলে না, যে মানুষের কোনো স্মৃতি নাই, সে আসলে কেউ না।

মৈশান: স্মৃতি হচ্ছে ব্যক্তির এক বিচ্ছেদ, বিচ্ছেদের শক্তিটা আসলে কী?

মনির: স্মৃতিটা হলো একটা বিরাট শক্তি। বিচ্ছেদ বা সেডনেস মানুষকে বড় করে তোলে। অনেক সময় কঠিন বিচ্ছেদের গভীর যে বেদনা, শিল্পীর কর্মকাণ্ডকে বাড়িয়ে দেয়। যদি সে সত্যিকার অর্থে কাজ করতে চায়। এগুলো একটা সম্পদ অবশ্যই। কিন্তু সুখ কি? সুখের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা কেই দিতে পারে না।

মোস্তফা: সুখের একটা ইউনিভার্সাল চেহারা আছে...

মনির: সুখের আছে। জীবনানন্দ তো বলে দিয়েছেন পরিষ্কার, জীবনের গভীরতম বেদনার মধুরতম প্রকাশেই আনন্দ। এটাই হলো সঠিক, জীবনের গভীরতম বেদনার মধুরতম প্রকাশ। মানুষ তো জীবনের দীর্ঘ সময় হাসে না। অথচ ওই হাসির সময় থাকে সবচেয়ে মেলোডি টাইম।

মৈশান: তবে কি আপনি যাপনের মধ্যে একটা পরমানন্দ অন্বেষণ করেন?

মনির: পরমানন্দ হলো একজন শিল্পীর কাজ করার সময়। কাজটা যে আমি করছি, সেটাই। একটা চিন্তা পার করছি এবং একসময় নতুন কিছু আমি করতে পারছি। ছবিটা হচ্ছে এই পর্যায়ের, ওই সময়টা বিরাট আনন্দের।

টিপু: আপনার পেইন্টিং সংগীতনির্ভর?

মনির: না। আমি সংগীত পছন্দ করি, কিন্তু ছবি আঁকার সময় সংগীত বাজানো পছন্দ করি না। আমার কাছে চিত্রকলার চেয়ে সংগীতের শক্তি অনেক বেশি। ভালো সংগীত আমার কাজকে বাধাপ্রস্ত করে।

মৈশান: আপনার ছবিতে এমনিতে সঙ্গীতের সিম্ফনি আছে কি না?

মনির: তা তো অবশ্যই।

মোস্তফা: মানে, ওটা কি সংগীত থেকে আসে?

মনির: না। বলা যায় ছবিটা সংগীতময়, কিন্তু এটা সংগীত থেকে আসে না। না। কারণ ভালো সংগীত শুনলে আমি ছবি আঁকতে পারি না। ওটা গ্রাস করে ফেলে... আবার অনেক চিত্রকরকে দেখছি বেশ জোরে জোরে মোৎসার্ট শুনছে, আর ওম, ওম করছে!

টিপু: আপনি পেইন্টিংয়ে কোথায় যেতে চান?

মনির: না, আমি কোথাও যেতে চাই না। কিন্তু আমার সমস্যা আছে, সমস্যা হলো, আমি একসঙ্গে অনেক ছবি আরম্ভ করি। একসময়, এই যে আমি অনেক দিন ধরে ছবি আঁকছি না, কারণ আমার ক্লান্তি। কোনোরকমে প্রদর্শনী করার জন্য আমি কাজ করি না। কারণ কোনো ‍কিছু আরোপ করে দিলে আমার কাজ হয় না। আমি চাইও না। প্রদর্শনীর তারিখ ঠিক করে ছবি আঁকা তো সমস্যা, তাই না। তো, আমি বলছি, ছবি আঁকার সময় বা আঁকলে অনেক সময় ক্লান্তি আসে, ইমেজ চলে যায়। আমি এখন বুঝি, ঘুম না হলে আমি পরিষ্কার ভিজ্যুয়ালাইশন পাই না। ক্লান্তি, এটা বয়স হলে বোঝা যায়। তারপরে শোনো, ছবি আমারে ছাইড়া চইলা যায়...

মৈশান: শেষ প্রশ্ন, আপনি তো স্পেনে আছেন, ওখানে তো মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান কালচারের একটা মিশ্রণ হয়েছে... ওখানে আপনার অভিজ্ঞতা কী?

মনির: আমি ৪০ বছরের সুবিধাপ্রাপ্ত একজন শিল্পী। প্রথমত এমন একটা দেশ স্পেন, যেখানে রোমানরা ছিল, আরবরা ছিল। টলেডো শহরে বা অন্য শহরে জুইস, মুসলিম এবং খ্রিস্টানরা ছিল। উইদাউট অ্যানি ফাইট। দেশটার আবহাওয়া ভালো, লোকগুলো ভালো, এবং খুব উন্নত সংস্কৃতি বলা যায়। আমার বাড়তি সুবিধা হলো, রোমান আর আরবদের দুটোই আমি নিতে পারি। এই পশ্চিমা সংস্কৃতি আর পূর্বের সংস্কৃতিদুটোই আলাদাভাবে আমি নিতে পারি। কোনটা নিবো কোনটা নিবো না, সেটা যেমন করা যায়, আবার এটা মিক্সড করতে পারি। অনেক সময় মেলাতে গেলে মেলানো যায় না। করলেও আলাদা রকমের ভিন্ন সংস্কৃতি হয়। পশ্চিমা যেটা তেল আর পানির মতো। আবার কতগুলো সর্বজনীন সংস্কৃতি।

মৈশান: এগুলো কি আপনার শিল্পে আসছে?

মনির: অবশ্যই। কারণ এত বছর থাকার পর না, আমার জীবনযাপন, ধরন, দৈহিক মনোজগতের দিক থেকে আমি বদলে গেছি। তবে আমার তো বাংলাদেশ আছে। অনেক স্মৃতি আছে।

টিপু: আপনার তাহলে কোনো দেশ নাই?

মনির: দেশ তো আছেই। হ্যাঁ, দেশ আছে। প্রত্যেকটা মানুষ একটা সীমানার ভেতরে পড়ে আছে। সে যদি ভিসা না পায় কোথাও যেতে পারে না।

মৈশান: একটা কথা, সাক্ষাৎকার দিতে আপনার কেমন লাগে?

মনির: না, সাক্ষাৎকারের চেয়ে আমি নির্মল আড্ডা পছন্দ করি। সাক্ষাৎকার ঠিক বুঝি না। আমি বাংলা ভালো বলতে পারি না।

মৈশান: তাহলে কি মানুষের সাথে কথা বলতে পছন্দ করেন?

মনির: অবশ্যই। হ্যাঁ, এটায় একটা দ্বন্দ্ব আছে। আমি এমনিতে নিঃসঙ্গ। একাকিত্ব মানুষকে বিমূর্ত করে। বাইরে সবকিছু করার পরও কিন্তু ঘরে বাস্তবে একাকী মানুষ। আবার একটা পর্যায়ে মানুষের একা থাকা দরকার। এত ব্যস্ততা, এত কাজ, পরিবার সবকিছু নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন আছে। কিছু উত্তর পাওয়া যায় বই থেকে। আবার এটারও খারাপ দিক আছে, একটা মানুষ যদি পাঁচ বছর বা দশ বছর একা থাকে, তখন তার অন্য মানুষের সাথে শেয়ার করে থাকা কঠিন।