সহস্র এক রজনীর গল্প
আমি বললাম, ‘তোমরা একে অপরের শত্রু হিসেবে নেমে যাও। পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল।’
[সুরা বাকারা, রুকু-৪, আয়াত-৩৬]
১
তাহলে লাল টিপ দিয়েই শুরু করা যাক সহস্র এক রজনীর গল্প...। শাহজাদি তার গোলাপি নেকাবে ঢাকা অবয়বে শীতসকালের ধলেশ্বরীর মতো আলো-জলে মাখামাখি অদ্ভুত এক ঢেউ তুলে বাঁকা চোখে তাকালেন সেনাপতির দিকে। সেনাপতি গর্জে উঠলেন: ‘ইউক্রেন নয় কেন?... খাঁ সাহেবের উইকেট যদি উড়ে যায়—দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ক্যাপ্টেন্স হেরেমের হবেটা কী গো! কৌন বাঁচায়গা হামারে পেয়ারে ইসলাম কো! হা হা হা।’
গোলাপি দুলতে থাকেন—দুলতেই থাকেন—যেন জবরদস্ত এক কাওয়ালির আসরে জাঁদরেল কোনো প্রতিপক্ষের মুখোমুখি তিনি। তার চোখ জেনারেলের উপচে পড়া গ্লাসে। আর তার গনগনে ঠোঁট থেকে অনিচ্ছুক আঙুরের মতো গড়িয়ে পড়ে কিছু শব্দ: ‘কথা তো সেই একই, জাহাঁপনা। প্রতি রাতে আমাদের একটি নাদুসনুদুস শিকার চাই। নাদুসনুদুস শিকার! তাকে কীভাবে মারা হবে, সেটা নির্ভর করছে আপনার মেজাজ-মর্জির ওপর। বন্দুকে অরুচি হলে আমরা টেঁটাও ব্যবহার করতে পারি। খাঁটি নরসিংদীর টেঁটা!’
২
পিষেই তো ফেলতে চাই আমি আপনাকে, আপনি আমাকে। টম অ্যান্ড জেরি। জেরি অ্যান্ড টম। আজ রাতে আপনি টম, আমি জেরি। আবার দাবার ছক পাল্টেও যেতে পারে এই রাতে কিংবা অন্য কোনো রাতে। সারকথা হলো, আপনি আমাকে নিয়ে খেলছেন, আমি আপনাকে। বিশাল এক দাবার বোর্ডের দুই প্রান্তে থাবা পেতে বসে আছি আমরা দুজন।
কী দুঃসাহস! আপনার-আমার মাথা টপকে এরই মধ্যে বাচ্চা মেয়েটি স্কুটি নিয়ে উঠে যায় কুড়িল ফ্লাইওভারে। [তসলিমা নাসরিনের মতো] সেও কিনা ভাবছে, দুনিয়াটাকে ভড়কে দেবে! দেবেই তো। দেবেই তো। একশবার দেবে। হাজারবার দেবে। কেননা ওর পিঠে সিগ্রেটের পোড়া দাগ। ওর হৃৎপিণ্ডে মনুষ্যনখরের দগদগে ঘা।
বাচ্চা মেয়েটি জানে না, কোনো খেলাই একতরফা নয়!
৩
চোরাই মোটরবাইকের ওপর আপনিই বসে আছেন আজানুলম্বিত আলখেল্লা পেতে। আর আমি হেঁটে যাচ্ছি খামারবাড়ির ভাঙা ফুটপাত ধরে। ঈগলের চেয়ে তীক্ষ্ণ আপনার চোখ। কত উঁচুতে আপনার আসন, তারপরও মুহূর্তে সব দেখে ফেলেন। স-অ-ব। আর কী আশ্চর্য, আপনি হুকুম জারি করবার আগেই খাঁটি নরসিংদীর টেঁটার মতো নেমে আসে আপনার ভয়ংকর থাবা। কেননা শিকারের ঘ্রাণ পেয়েছে সে। নাদুসনুদুস শিকার!
থাবা তো আর জানে না, শিকারটি অকস্মাৎ ঘুরে দাঁড়াবে। তার উদ্যত ফণা পৌঁছে যাবে আপনার কণ্ঠনালি পর্যন্ত। আর জানলেই-বা কী, গল্পটা তো শেষ পর্যন্ত শিকার ও শিকারির! চোরাই মোটরবাইকের ওপর আমিই বসে থাকতে পারতাম উত্তাল শরীরের মায়াবী টোপ ফেলে। আর হেঁটে যেতে যেতে জামাল খাসোগির মতো আচমকা বড়শিতে বেমক্কা ঝুলে যেতে পারত আপনার চর্বিবহুল দেহ।
যুবরাজ জানে, কোনো খেলাই একতরফা নয়। কিন্তু পরোয়া করে না—কেননা তার আছে আলাদিনের আশ্চর্য এক চেরাগ।
৪
ভলোদিমির জেলেনস্কি জেনেশুনেই ফাঁদ পেতেছিল। টোপও ছিল খাসা। আরেক ভ্লাদিমির ক্ষুধার্ত শ্বেতভল্লুকের মতো সেই টোপ গলা পর্যন্ত গিলে বসে আছে! দেখুন, ইউক্রেন যখন পুড়ছে, তার দেবদূতসদৃশ নারীশিশুসমেত, জেলেনস্কি তখন মুখ টিপে হাসছেন—বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করছেন—সার্কাসের জোকারের মতো। বেকুব ভল্লুকটাকে এবার বরফজলে চুবিয়েই ছাড়বেন তিনি!
‘শেহেরজাদি!’—হুংকার ছাড়লেন জেনারেল, ‘তুমি জানো, ওসব ফালতু গল্প শোনার সময় আমার নেই।’
‘জাহাঁপনা, আপনিই তো শুনতে চাইলেন...।’
‘তুমি কি অই বেকুব ভল্লুকটার মতো আমাকেও বেকুব মনে করো, অ্যাঁ? বরফসমুদ্রে যার জন্ম তুমি কিনা তাকে বরফজলের ভয় দেখাচ্ছ!’
‘জাহাঁপনা, সে তো দুনিয়া জানে। [কেবল ভলোদিমির জানে না!]
৫
আসলে সেটি ছিল সত্যিকারের এক রক্তসমুদ্র। তার ভাইয়ের রক্ত এসে মিশেছিল সেখানে। তার গর্ভধারিণীর সম্ভ্রম এসে মিশেছিল সে সমুদ্রে। তার পাড়া-প্রতিবেশী-স্বজন—যাদের সঙ্গে সে খেলত শৈশবে, তাদের রক্ত এসে মিশেছিল সেখানে। আত্মভোলা যে-কিশোরটিকে দেবে বলে যত্নে গেঁথেছিল বকুলের মালা—সেই অধরা স্বপ্নের রক্ত এসে মিশেছিল সেখানে। তাই সমুদ্রটিকে সিঁদুরের মতো আপন ললাটে ধারণ করেছিল মেয়েটি—মহামতি শিব যেভাবে তার জটায় ধারণ করেছিল স্বর্গজাত পবিত্র গঙ্গাকে।
দিগন্তজোড়া সবুজ কলরোল নিয়ে সেই রক্তসমুদ্র এখন পতপত করে উড়ছে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে—এমনকি ধূলিমগ্ন তেজগাঁও কলেজেও। আমাকে বলতেই হবে, জাহাঁপনা, সবটাই এক অলৌকিক তর্জনীর কারসাজি। এ হলো আমাদের আলাদিনের চেরাগ—যা কখনোই নির্বাপিত হয় না। তেরশত রক্তনদী পার হয়ে আলোকের সেই ঝরনাধারায় স্নাত হতে হতে সুবর্ণজয়ন্তীর কুসুমাস্তীর্ণ পথরেখা ধরে মেয়েটি হেঁটে যাচ্ছিল আনমনে [হয়তোবা গুনগুন করে গাইছিল—‘ও আমার দেশের মাটি...’], তখনই ষাঁড়টি গর্জন করে উঠেছিল। জাহাঁপনা, ঠিক তখনই।
‘শহরে আবার ষাঁড় এলো কোত্থেকে? কী সব গাঁজাখুরি গল্প...!’
গোস্তাকি মাফ করবেন, জাহাঁপনা। রেড ওয়াইনসহযোগে আস্ত দুম্বার রোস্ট খেতে খেতে ষাঁড়টিকে আপনি ঠিকই দেখেছেন কলোসিয়ামে, প্লাজা ডি তোরোসে, গুয়ের্নিকায়। কুরুক্ষেত্র থেকে, কারবালা থেকে, রায়েরবাজার থেকে, চুকনগর থেকে, বত্রিশ নম্বর থেকে, জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে, মিরপুর জল্লাদখানা থেকে, আউশউইৎস বন্দিশিবির থেকে অবিরাম ভেসে আসছে সেই শিংয়ের গর্জন।
জাহাঁপনা, আপনি কি একটু দোচুয়ানি ট্রাই করে দেখবেন?