আজীবন নিমগ্ন শিল্পী কামরুল হাসান
শিল্পী কামরুল হাসানের সঙ্গে আমার সরাসরি পরিচয় হয়েছিল ষাটের দশকের মধ্যভাগে। আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখন দেশজুড়ে পাকিস্তান সামরিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলছে সাহসী ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬২ সালে শুরু হয়ে যা চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছিল ১৯৭০-৭১ সালে।
এই পুরো সময়কালজুড়ে আমরা ছিলাম দেশের তৎকালীন প্রধান ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের সক্রিয় কর্মী এবং গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। সে সময় পোস্টার-ব্যানার লেখা থেকে শুরু করে মঞ্চ সাজানো পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলনের নানা কর্মকাণ্ডে দেশের প্রধান শিল্পীদের আমরা সংযুক্ত করতে পেরেছিলাম নানাভাবে। বিশেষ করে আমাদের অনুষ্ঠানগুলোর কার্ডগুলো হতো অত্যন্ত সুন্দর, শিল্পনৈপুণ্যে অভিনব। একটা নতুনত্ব নিয়ে আসা হয়েছিল তাতে।
সেই ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় এবং পরে ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদের রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী ও নববর্ষ ইত্যাদি উপলক্ষে প্রকাশিত কার্ডগুলো শিল্পী কামরুল হাসান নিজ হাতে লিখে ও এঁকে দিতেন। সেগুলো নানা রঙে ছেপে বিলি করতাম আমরা। সেই কার্ড, ছবি বা লেখাগুলো আমার চোখে এখনো স্পষ্ট ভাসে।
একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সে সময় ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদ থেকে আমরা সংকলন বের করতাম। সে জন্য প্রচ্ছদ, ভেতরের ড্রয়িং ইত্যাদি সংগ্রহ করতাম বিভিন্ন শিল্পীর কাছ থেকে। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ছাত্র ইউনিয়নের সংকলন সূর্য জ্বালার জন্য ‘একুশের বিহঙ্গ’ শিরোনামের একটি ড্রয়িং এঁকে দিয়েছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান। হলুদ ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর লাল রঙে আঁকা এক নারী ও উড়ে যাওয়া তিনটি বিহঙ্গ সবাইকে আকৃষ্ট করবে। ১৯৬৯ সালে ছাত্র ইউনিয়ন প্রকাশিত একুশে স্মরণে সংকলনের জন্য তিনি এঁকে দিয়েছিলেন সাদা-কালো ড্রয়িং ‘নতুন দিনের ভোর’। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ প্রকাশিত একই শিরোনামের সংকলনটিতেও আমরা ছেপেছিলাম তাঁর আঁকা একটি ছবি। সেখানে ছিল আরও ১৩ জন সেরা শিল্পীর ড্রয়িংয়ের পাশে সেরা কবিদের কবিতা।
নদী ও নারী [জল রং : ১৯৮৭] কামরুল হাসান © ছবি: লেখকের সৌজন্যে
ষাটের দশকের সে সময়টিতে কামরুল হাসান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ডিজাইন সেন্টারের প্রধান ছিলেন। ডিজাইন সেন্টারের আরও তিনজন শিল্পীর কাছ থেকে আমরা নানা সহযোগিতা পেয়েছি তখন। তাঁরা হলেন আবদুল মুকতাদির, মোহাম্মদ ইদ্রিস ও গোলাম সারোয়ার। আসলে কামরুল ভাইয়ের নেতৃত্বে ডিজাইন সেন্টারের পরিবেশটি আমাদের জন্য বেশ অনুকূল ছিল। তাঁদের সাহায্য-সহযোগিতা আমরা সব সময় চেয়েছি, পেয়েছিও।
শিল্পী আবদুল মুকতাদির আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের নানা কাজে সহায়তা করতেন। ঝড়ের খেয়া [১৯৬৬], অরণি [১৯৬৮] ও নিনাদ [১৯৬৯]—এই তিনটি একুশের সংকলনের প্রচ্ছদ তিনি করেছিলেন। গোলাম সারোয়ারের কথাও মনে পড়ে। সে সময় দুবার আমরা তাসের দেশ করেছিলাম; একবার ইমদাদ হোসেন এবং আরেকবার মুস্তাফা মনোয়ারের পরিকল্পনায় গোলাম সারোয়ার ও রমেন দত্ত সাহায্য করেছিলেন। পুরান ঢাকার হৃষিকেশ দাশ রোডে মোহাম্মদ ইদ্রিসের একটি ছোট প্রেস ছিল। সেখানে ছাপা-সংশ্লিষ্ট নানান কাজ করেছি আমরা।
কামরুল ভাই একটা লম্বা সময় থাকতেন মনিপুরীপাড়ায়। সে সময় সকাল-বিকেল নানা কাজে তাঁর বাসায় যেতাম। এমন একটি দিন পাওয়া যাবে না, যেদিন বাসায় গিয়ে আমি কামরুল ভাইকে কাজবিহীন বসে থাকতে দেখেছি। ছবি আঁকা, লেখালেখি—কিছু না কিছুতে নিমগ্ন থাকতেনই সব সময়। তাঁর সঙ্গে ছবি নিয়ে গল্প করা, ছবি খুঁজে বের করা—ব্যস্ত থাকতাম ইত্যাদি কাজে। কাজের বাইরেও তাঁর ছবি সংগ্রহ করা ছিল আমার লক্ষ্য...
দুই নারী [১৯৮৭] © লেখকের অনুরোধে নিজের আগের ছবির কপি করেন শিল্পী কামরুল হাসান © ছবি: লেখকের সৌজন্যে
২
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে কামরুল ভাইয়ের সঙ্গে আবার আমাদের নানা কার্যক্রম শুরু হয় নতুন করে, যদিও তখন আমরা নানামুখী রাজনৈতিক কাজে জড়িত হয়ে পড়েছি। আমি পুরোপুরি যুক্ত হয়েছি সাপ্তাহিক একতার কাজে। সে সময় সাপ্তাহিক একতা ও আমাদের সঙ্গে কামরুল ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনেকবার তাঁর কাছে গেছি একতার জন্য আঁকা বা লেখা সংগ্রহ করতে। সাধ্যমতো সহায়তা করেছেন তিনি। ’৭৮-এর ২১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যার জন্য একতাকে একটি স্কেচ দিয়েছিলেন। ’৮৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে দিয়েছিলেন ‘একুশের ভাবনা’ শিরোনামে একটি ছোট নিবন্ধ ও স্কেচ। সে বছরই একতার ১৪-তম বার্ষিকীতে একটি ড্রয়িং ও ছোট শুভেচ্ছাবার্তা দিয়েছিলেন। শুভেচ্ছাবার্তায় লিখেছিলেন, ‘একতা অবশ্যই এগিয়ে যাবে সংহত ও সংযমী চরিত্র নিয়ে, যা একদিন প্রচণ্ড শক্তি জোগাবে, যে শক্তি সকল অন্যায়-অত্যাচার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সকল মানুষকে একতাবদ্ধ করতে সক্ষম হবে। যে শক্তি বাস্তব ক্ষেত্রেই আমাদের সেই কাক্সিক্ষত উত্তরণ শিখরে নিয়ে যাবে।’
এরশাদের শাসনামলে এক বছর বন্ধ থাকার পর ১৯৮৭ সালের এপ্রিলের শুরুতে পুনরায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক একতা। শিল্পী কামরুল হাসান আবার একতাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি ড্রয়িং দেন।
৩
ছবি সংগ্রহের দিকে আমার ঝোঁক তৈরি হয় আশির দশকের শুরু থেকে। তখন সে রকম আর্থিক সামর্থ না থাকলেও শিল্পীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সুযোগ হয় স্বল্পমূল্যে ছবি সংগ্রহের। সে সময় কাউকে কোনো ভালো উপহার দিতে হলে আমরা কামরুল ভাইয়ের ছবি দিতাম।
একবার মালেকা বেগম ভিয়েতনাম গেল। ওখানকার নারী সংগঠনের জন্য কী উপহার নিয়ে যাবে? কামরুল ভাই তাঁর একটি ছবি দিলেন। সেটি বাঁধাই করে নিয়ে গেল মালেকা। একইভাবে আশির দশকের মধ্যভাগে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত নিকোলাই স্তেপানভের বিদায় উপলক্ষে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে দেওয়া হয় জলরঙে আঁকা কামরুল ভাইয়ের একটি ছবি। বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির বিদায়ী উপহারও ছিল কামরুল ভাইয়ের আঁকা ছবি। এভাবেই কামরুল হাসানের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ও সম্পর্ক অব্যাহত থাকে। একবার কামরুল ভাইয়ের জন্য আমি কলকাতা থেকে ভালো মানের এক বক্স বোর্ড কাগজ এনে দিয়েছিলাম মনে পড়ে।
কামরুল ভাই একটা লম্বা সময় থাকতেন মনিপুরীপাড়ায়। সে সময় সকাল-বিকেল নানা কাজে তাঁর বাসায় যেতাম। এমন একটি দিন পাওয়া যাবে না, যেদিন বাসায় গিয়ে আমি কামরুল ভাইকে কাজবিহীন বসে থাকতে দেখেছি। ছবি আঁকা, লেখালেখি—কিছু না কিছুতে নিমগ্ন থাকতেনই সব সময়। তাঁর সঙ্গে ছবি নিয়ে গল্প করা, ছবি খুঁজে বের করা—ব্যস্ত থাকতাম ইত্যাদি কাজে। কাজের বাইরেও তাঁর ছবি সংগ্রহ করা ছিল আমার লক্ষ্য।
একবার কামরুল হাসানের বাসায় গিয়ে দেখি তিনি মগ্ন হয়ে জলরঙে ছোট ছোট ছবি আঁকছেন। আমাকে দেখে বললেন যে তিনি সাধারণ বীমা করপোরেশনের ক্যালেন্ডারের জন্য জলরঙে ১২টি ছবি আঁকছেন। দেখতে দেখতে দুটি ছবি আমার খুবই পছন্দ হলো। বললাম, কামরুল ভাই, আমি এই দুটি ছবি নিতে চাই।
তিনি বললেন, টাকা আছে?
বললাম, আছে। কত?
এক হাজার করে দাও। মোট দুই হাজার টাকা।
আজ অবিশ্বাস্য মনে হলেও এমনই ছিলেন আমাদের কামরুল ভাই।
এভাবে কামরুল ভাইয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে ছবি সংগ্রহ করেছি। হয়তো বেশ কিছুকাল আগে আঁকা কোনো ছবি আমার ভালো লেগেছে, যেটা কোনো প্রদর্শনীতে বিক্রি হয়নি বা সেভাবে সমাদৃত হয়নি—এ রকম ছবি আমি পছন্দ করে সংগ্রহ করেছি তাঁর কাছ থেকে। একবার কামরুল ভাইয়ের একটা ছবি আমার খুব পছন্দ হলে সেটা আমি তাঁকে কপি করে দিতে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি আমাকে কপি করে দিয়েছিলেন, তবে কিঞ্চিৎ বিরক্তিও প্রকাশ করেছিলেন সেটার অর্থমূল্যের ব্যাপারে। অবশ্য আমি তাঁর কথা রেখেছিলাম।
একবার কামরুল হাসানের বাসায় গিয়ে দেখি তিনি মগ্ন হয়ে জলরঙে ছোট ছোট ছবি আঁকছেন। আমাকে দেখে বললেন যে তিনি সাধারণ বীমা করপোরেশনের ক্যালেন্ডারের জন্য জলরঙে ১২টি ছবি আঁকছেন। দেখতে দেখতে দুটি ছবি আমার খুবই পছন্দ হলো। বললাম, কামরুল ভাই, আমি এই দুটি ছবি নিতে চাই
শিরোনামহীন [জল রং: ১৯৮৭] কামরুল হাসান © ছবি: লেখকের সৌজন্যে
আমার বিশেষ চিন্তা ছিল, ধীরে ধীরে স্বল্পমূল্যে কামরুল ভাইয়ের ভালো ছবি সংগ্রহ করব। একই সাথে সব ধরনের ও সব মাধ্যমের ছবি সংগ্রহ করব—যেমন স্কেচ থেকে জলরং, প্যাস্টেল, পোস্টার কালার; আবার তেলরঙের কাজ, সেটা কাঠের ওপরে অর্থাৎ কার্ডবোর্ডে, ক্যানভাস বা বোর্ড কাগজের ওপরে ইত্যাদি।
আরেকটা ব্যাপার, সব সময় আমার আগ্রহ ছিল ছোট আকৃতির ছবির দিকে, কারণ বড় ছবি টাঙাতে বাসায় অনেক বেশি জায়গা লাগে। ড্রয়িংয়ের বেলায় আমার আগ্রহ ছিল নারী-পুরুষ, পশু-পাখি, কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ ইত্যাদি নানা বিষয়ে। আবার যখন প্রিন্টের ছবি সংগ্রহ করি, কাঠ খোদাই, এচিং, লিথোগ্রাফ ও সেরিওগ্রাফ ইত্যাদিতে আকর্ষণ ছিল। যদিও আমি কামরুল ভাইয়ের কাছ থেকে এচিং মাধ্যমের প্রিন্ট পাইনি। তবে আমার বন্ধু আবুল হাসনাত আমাকে একটি এচিং প্রিন্ট উপহার দিয়েছিল।
সরাসরি শিল্পী কামরুল হাসান ছাড়াও তাঁর ছবির প্রদর্শনী ও ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে আমি কামরুল ভাইয়ের ছবি সংগ্রহ করেছি। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মীজানুর রহমানের কাছে তাঁর বেশ কিছু ছবি ছিল। মীজানুর ভাইয়ের মৃত্যুর পর সেগুলো নিয়ে বেঙ্গল গ্যালারিতে একটি প্রদর্শনী হয়েছিল। সেখান থেকে আমি বেশ কিছু ছবি সংগ্রহ করেছিলাম। এ ছাড়া সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদের ‘শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে’ কামরুল ভাইয়ের ছবির একটি প্রদর্শনী হয়েছিল। সেখান থেকে আমি দুটি ছবি সংগ্রহ করেছিলাম। বিএনপির মন্ত্রী শামসুল ইসলাম সাহেবের সংগ্রহের একটি ছবি তিনি তাঁর ঘরে টাঙাতে চাননি। ছবিটি তিনি রেখে দিয়েছিলেন গাড়ির গ্যারেজে। সেটি তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। এর পরিবর্তে অবশ্য একটি কামরুল হাসান ও একটি কাইয়ুম চৌধুরীর ছবি দিয়েছিলাম তাঁকে। সুবীর চৌধুরীর কাছ থেকেও একটি প্যাস্টেলে নারীর ড্রয়িং সংগ্রহ করেছিলাম।
এখন একটি বিষয়ে বিস্মিত হই, কামরুল ভাইয়ের মধ্যে ছবির মূল্য নির্ধারণে কখনোই বিশেষ উচ্চমূল্য চাওয়ার কোনো তাগিদ ছিল না। মানুষ তাঁর ছবি সংগ্রহে রাখবে, দেয়ালে টানাবে—এতেই যেন তাঁর সকল আনন্দ ছিল। সে জন্য বাংলাদেশের সে সময়ের রুচিশীল মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণি বা যারা কিছুটা ধনাঢ্য হয়েছেন, তাদের বাসায় গেলে আমরা কামরুল হাসানের ছবি দেখতে পাই। যেমন কলকাতায় দেখা যায় যামিনী রায়ের ছবি।
এখনো আমি কামরুল হাসানের ছবি খুঁজি, পেলে সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। তাঁর সম্পর্কে যা-ই প্রকাশ হয়, সেটা আগ্রহ নিয়ে পড়ি। তাঁর ছবি ছাড়াও আমার সংগ্রহে আছে শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া, রশীদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, কাজী আবদুল বাসেত, রফিকুন নবী, কাজী গিয়াসউদ্দিন, শহীদ কবির প্রমুখের শিল্পকর্ম। এই শিল্পীদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁদের জীবন-স্বপ্নের সঙ্গে আমার চিন্তা-চেতনার একটা সংযুক্ততা আছে।
এর বাইরেও কলকাতা বা ভারতের শিল্পীদের মধ্যে শিল্পী যামিনী রায়, পরিতোষ সেন, কে জি সুব্রামানিয়াম, গোপাল ঘোষ, গনেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য, যোগেন চৌধুরী প্রমুখের কিছু শিল্পকর্ম আমার কাছে আছে। আরও আছে মকবুল ফিদা হোসেইন, ডি সুজা, সোমনাথ হোর ও গনেশ হালুইয়ের ছাপচিত্র।
এখন একটি বিষয়ে বিস্মিত হই, কামরুল ভাইয়ের মধ্যে ছবির মূল্য নির্ধারণে কখনোই বিশেষ উচ্চমূল্য চাওয়ার কোনো তাগিদ ছিল না। মানুষ তাঁর ছবি সংগ্রহে রাখবে, দেয়ালে টানাবে—এতেই যেন তাঁর সকল আনন্দ ছিল। সে জন্য বাংলাদেশের সে সময়ের রুচিশীল মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণি বা যারা কিছুটা ধনাঢ্য হয়েছেন, তাদের বাসায় গেলে আমরা কামরুল হাসানের ছবি দেখতে পাই
ড্রইং [তুলি ও কলম] কামরুল হাসান © ছবি: লেখকের সৌজন্যে
৪
কামরুল হাসান তাঁর সময়ের একজন সেরা শিল্পী ছিলেন। এ কথা বলতে আমি দ্বিধা বোধ করব না যে তিনি শুধু এই উপমহাদেশের নয়, একজন বিশ্বমানের বড় শিল্পী ছিলেন। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক কামরুল ভাইকে নিয়ে বলেছিলেন, বিশ্বের সেরা পাঁচজন ড্রয়িং মাস্টারের মধ্যে তিনি একজন। সৈয়দ হকের সঙ্গে আমি ঐকমত্য পোষণ করি।
কামরুল ভাইয়ের জন্ম কলকাতায়। সেখানেই বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া, আর্ট কলেজ থেকে পাস করা—তারপর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এক রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর সব কর্মকাণ্ডে সব সময় একটা গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। সেখানে দেশীয় সংস্কৃতি, দেশের মানুষ, বিশেষ করে কৃষক, শ্রমজীবী, স্বাধীনতাসংগ্রামী—তাঁদের প্রতিচ্ছবি আমরা দেখি। নারী ছিল তাঁর চিত্রকলার এক বড় অনুপ্রেরণা। তিনি বলতেন, পিকাসো তাঁর গুরু। তাঁর ড্রয়িং থেকে শুরু করে তেলরঙের ছবিতে আমরা নানাভাবে পিকাসোর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব দেখি।
কামরুল ভাইয়ের কথা আমরা সব সময় স্মরণ করি। এ রকম একজন উদার, মানবিক, সংগ্রামী শিল্পী আমাদের প্রজন্ম দেখেছে এবং ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছে, এটা আমাদের জন্য বড় আনন্দদায়ক, বড় প্রাপ্তি।
শিল্পী কামরুল হাসান, আমাদের কামরুল ভাইকে আমরা যথাযথভাবে দেশে-বিদেশে উপস্থাপন করতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে আমাদের অনেক ব্যর্থতা রয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী এবং অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হককে নিয়ে একটি বৈঠক করে কামরুল ভাইয়ের ছবির বড় একটি বই ইংরেজিতে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কাইয়ুম ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যুতে সেটা বন্ধ হয়ে যায়।
কামরুল হাসানকে নিয়ে সেদিনের সেই উদ্যোগ সফল না হলেও কলাকেন্দ্রের পক্ষ থেকে ওয়াকিলুর রহমান সহজিয়া শিরোনামের এই বইটি প্রকাশ করার যে উদ্যোগ নিয়েছেন, সে জন্য তাঁকে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই। এই বইয়ে আমরা হয়তো পূর্ণ কামরুল হাসানকে পাব না, তাতে ক্ষতি নেই। যতটুকু পাওয়া যাবে, তাতে শিল্পরুচিশীল মানুষের তৃষ্ণা কিছুটা হলেও মিটবে আশা করি।