শিল্পশিক্ষা সম্পর্কে আমাদের সমাজ দুঃখজনকভাবে উদাসীন
রশিদ চৌধুরী [Rashid Choudhury]
চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও শিক্ষাবিদ। জন্ম ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার রতনদিয়া গ্রামে। পুরো নাম ‘রশীদ হোসেন চৌধুরী’। পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের আধুনিক শিল্প-আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে স্বকীয় শিল্পচর্চার সূচনা করেছিলেন। পাশ্চাত্যের সর্বাধুনিক টেকনিক প্রয়োগ করে একদিকে বিমূর্ত চিত্রকলা, অন্যদিকে পাট-রেশমের সমাহারে তাপিশ্রী [বুনন শিল্প] নির্মাণ তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ চিত্রকলা। তাপিশ্রীর পাশাপাশি প্রচলিত তেলরঙ ছাড়াও তিনি কাজ করেছেন টেম্পেরা, গুয়াশ এবং জলরঙ ইত্যাদি অপ্রচলিত মাধ্যমে। জীবনের শেষ বছরগুলো ক্যালিগ্রাফি এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক প্রভাব তাঁর শিল্পকর্মে রূপায়িত হতে দেখা যায়।
একক, যৌথ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক প্রদর্শনীতে রশিদ চৌধুরী উচ্চ প্রশংসা লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় তাঁর একক প্রদর্শনী হয়। তাঁর অজস্র শিল্পকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: ধান কাটা [তৈল, ১৯৫৩], চাকমা তরুণী [ড্রয়িং, ১৯৫৭], প্রকৃতি [তৈল, ১৯৬০], ষড়ঋতু [দেয়াল/তৈল/তাপিশ্রী, ১৯৬৭], রঁদেভু [গুয়াশ, ১৯৬৮], রোমান্স [তাপিশ্রী, ১৯৭০], জাদুঘর [তাপিশ্রী, ১৯৭০], সোনাভানু [তাপিশ্রী, ১৯৭০], বাংলায় বিদ্রোহ [গুয়াশ, ১৯৭১], আমার সোনার বাংলা [তাপিশ্রী, ১৯৭৫], দুর্বিনীত কাল [তৈল, ১৯৮০], আদম [তাপিশ্রী, ১৯৮২], চিত্রাঙ্গদা [তৈল, ১৯৮৩], কাল বৈশাখী [তাপিশ্রী, ১৯৮৫] ইত্যাদি। শিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৭ সালে একুশে পদক এবং ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার পান।
রশিদ চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অধ্যয়ন ও চট্টগ্রাম শহরে একটি চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। রশিদ চৌধুরী ১৯৮৬ সালের ১২ ডিসেম্বর মারা যান। তর্ক বাংলায় প্রকাশিত তাঁর দুষ্প্রাপ্য সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় অধুনা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় [১ম বর্ষ ২৪তম সংখ্যা, ২৬ অক্টোবর ১৯৭২]। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন কে, সেই তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কোনো অনুসন্ধানী পাঠক বা সংশ্লিষ্ট কেই জানালে আমরা নামটি ভবিষ্যতে সংযুক্ত করব। তবে সে সময় পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন কবি ও প্রাবন্ধিক ফজল শাহাবুদ্দীন। প্রায় ৫০ বছর আগের এই সাক্ষাৎকারের বিষয়-চিন্তা এখনো উজ্জ্বল ও সমকালীন। তাই তর্ক বাংলার পাঠকদের জন্য হাজির করা হলো।
—সম্পাদক
রশিদ চৌধুরী © ছবি: উইকিপিয়ার সৌজন্যে
প্রশ্ন: গণমুখী শিল্প সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
রশিদ চৌধুরী: আমি এ ধরনের কোনো বিশেষ শব্দে শিল্পকে বিশেষিত করতে চাই না। আগেই বলেছি, শিল্প হবে সকলের জন্য, সমাজ ও জীবনকে সুন্দর করার জন্য। সে জন্য সরকারকে, সমাজকেই হতে হবে গণমুখী।
প্রশ্ন: শিল্পীর প্রতি সমাজের দায়িত্ব কতটুকু?
রশিদ চৌধুরী: প্রথমে দেখতে হবে শিল্পী কী ধরনের সমাজে বাস করেন। একটি আদর্শ সমাজ মানুষকে সুন্দরভাবে বাঁচতে সাহায্য করে। জীবনের প্রতিটি প্রয়োজন সেখানে সুষ্ঠুভাবে মেটানো সম্ভব। একটি সমাজ গড়ে তোলার মাধ্যমে জীবনকে সুন্দর করাই হচ্ছে শিল্প তথা সুন্দরের প্রতি সমাজের দায়িত্ব।
প্রশ্ন: আপনি কি সোভিয়েত কিংবা চীনের সমাজব্যবস্থাকে আদর্শ বলে মনে করেন?
রশিদ চৌধুরী: অবশ্যই করি। তবে একটা ব্যাপারে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। পাশ্চাত্যের সবকিছুই খারাপ, এটা আমি মনে করি না। ওরা যান্ত্রিক দক্ষতার দিক থেকে বহুদূর এগিয়ে গেছে, যা সমাজের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, যা কিছু ভালো তা গ্রহণ করতে যেন আমাদের কোনো দ্বিধা না থাকে।
প্রশ্ন: তাহলে কি আপনি বলতে চান, শিল্পীর নিজস্ব বলতে কিছু থাকা উচিত নয়?
রশিদ চৌধুরী: শিল্পীকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখছেন কেন? অন্য সবার মতো শিল্পীরাও তো সেই সমাজের অংশ।
প্রশ্ন: শিল্পীরা কীভাবে কাজ করবেন?
রশিদ চৌধুরী: গোষ্ঠীবদ্ধভাবে। কয়েকজন মিলেই কোনো কাজ করা যেতে পারে। ব্যক্তিগত অবদান হিসেবে অবশ্য তাদের নাম থাকতে পারে। তবে এর বেশি নয়।
প্রশ্ন: আপনি কি বলতে চান, শিল্পীরা রাজনৈতিক প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে?
রশিদ চৌধুরী: না, তা-ও...না। কারণ, প্রচার মাধ্যম হিসেবে চিত্রকলা খুবই দুর্বল মাধ্যম। তার চেয়ে বহুগুণ সবল মাধ্যম হচ্ছে আলোকচিত্র বা চলচ্চিত্র, কয়েক ঘণ্টার ভেতর যার লাখ লাখ প্রতিলিপি বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। চিত্রকলা বা ভাস্কর্যশিল্পকে ঠিক সেভাবে ব্যবহার করা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: আমাদের দেশে শিল্পীরা সমাজের প্রতি তাঁদের দায়িত্ব কীভাবে পালন করেছেন?
রশিদ চৌধুরী: আমাদের এখানে সেই সমাজ আজ অবধি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গত চব্বিশ বছর [পাকিস্তান আমল] শিল্পীদের প্রতি ইসলামীকরণের নামে কী ধরনের আচরণ করা হয়েছে, সেটা কারও অজানা নয়। আমাদের দেশের কোনো নেতা কোনো দিন শিল্প সম্পর্কে আগ্রহ দেখিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। শিল্পীরা তাই নিজেদের জীবিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। বিদেশমুখী হয়েছেন। যার ফলে সত্যিকার শিল্প বলতে সে রকম কিছু সৃষ্টি হয়নি। তা সত্ত্বেও এ দেশের শিল্পীরা স্বাধীনতাসংগ্রামে যেভাবে অংশগ্রহণ করেন তার তুলনা হয় না।...ইতিপূবে তাঁরা সবাই ছিলেন বিচ্ছিন্ন এবং নিঃসঙ্গ।
প্রশ্ন: আপনি বলছেন, শিল্পীরা শুধু সমাজের প্রয়োজন মেটাবেন। তাহলে সৃজনশীল শিল্পের বিকাশ কীভাবে ঘটবে?
রশিদ চৌধুরী: একটি আদর্শ সমাজে দু’ধরনের শিল্পী থাকতে পারে। একদল হবেন পুরোপুরি সমাজের জন্য। এঁদের সৃজনশীল শিল্পী বলা যেতে পারে। এঁরা শিল্প সম্পর্কে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবেন। যার ফসল গ্রহণ করবেন অন্যান্য শিল্পী এবং যথাযথভাবে প্রয়োগ করবেন। এভাবে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটতে পারে।
জিপসি © রশিদ চৌধুরী
প্রশ্ন: শিল্পের প্রয়োজন সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে মেলে। পাশ্চাত্য ভাবধারায় দীক্ষিত শিল্পীর কাছে শিল্পের প্রয়োজন অন্য রকম। কিন্তু সেখানেও কীভাবে শিল্প সৃষ্টি সম্ভব হচ্ছে?
রশিদ চৌধুরী: পাশ্চাত্যের শিল্পসম্পর্কিত অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। অতীতে শিল্প ছিল পুরোপুরি সামন্তবাদের অধীনে, প্রভাব ছিল সামন্তবাদের। এরপর ক্রমাগত রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে শিল্পীরাও বিদ্রোহ করেছেন প্রচলিত নিয়মের বিরুদ্ধে, শিল্পী ক্রমশ মতবাদের যুগে প্রবেশ করেছেন। এভাবে বিদ্রোহের ভেতর দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে মহৎ শিল্প। মহৎ মানের শিল্পসম্পর্কিত জ্ঞান সবটুকুই অতীতের অভিজ্ঞতা ও বিবর্তনের ধারা থেকে [পাওয়া]। বর্তমান পুঁজিবাদের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এবং সামন্তবাদের সঙ্গে পুঁজিবাদের দ্বন্দ্বের ফলে শিল্পের নবতর মূল্যবোধ জন্ম নিয়েছে। তৈলচিত্রের রাজসিকতাকে সামন্তবাদ উৎসাহ প্রদান করলেও পুঁজি ঝুঁকছে যান্ত্রিকীকরণের দিকে। ব্যাপক প্রসার ঘটেছে গ্রাফিক ও অন্য মাধ্যমের। যন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের উৎপাদনও পরিবর্তিত হচ্ছে। পরোক্ষভাবে সমাজের প্রয়োজনও কিছুটা মেটানো সম্ভব হচ্ছে একজন সামন্ত প্রভুর সুরক্ষিত দুর্গে অবস্থিত একখানা তৈলচিত্র, যা গ্রাফিকে রূপ নিয়ে শত শত প্রিন্ট হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। ...ভাস্কর্য আজ রাস্তার মোড়ে মোড়ে ঠাঁই নিয়েছে, যান্ত্রিকতার চাপে ক্লান্ত পথচারী দু’দণ্ডের জন্য যা দেখে তৃপ্তি পাচ্ছেন। এভাবে পাশ্চাত্যের দেশে বর্তমানে শিল্প সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রশ্ন: শিল্পের উপকরণ কিংবা মাধ্যম [হিসেবে] আপনি কি ক্যানভাস কিংবা তেলরংকে অস্বীকার করছেন?
রশিদ চৌধুরী: অস্বীকার আমি করছি না। বর্তমান যুগই অস্বীকার করতে চাইছে। অতীতের শিল্পকলার ক্রমবিবর্তনের ধারা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন—উপকরণ সর্বদা যুগের চাহিদা অনুযায়ী রূপ পাল্টেছে। গির্জা কিংবা দুর্গের গাত্র থেকে চিত্রকলা যখন প্রথম ক্যানভাসে আশ্রয় গ্রহণ করল, তখন সেটা যুগের প্রয়োজনেই হয়েছিল। কারণ, সে সময় সামন্ত প্রভুরা চেয়েছিলেন তাঁর প্রভুর ছবি দুর্গের দেয়ালে অঙ্কিত না হয়ে এমন এক মাধ্যমে অঙ্কিত হোক, যা তিনি কোথাও যাবার সময়ে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন। বর্তমান সময়ে গ্রাফিকের প্রতি যে দুর্বলতা দেখাচ্ছে, তার কারণ যান্ত্রিকতার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নকলের প্রসার এত ব্যাপকভাবে বেড়েছে যে, পিকাসো ইত্যাদির হুবহু নকল করা এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। তাই নকলের হাত থেকে বাঁচার জন্যই অপেক্ষাকৃত সুলভ গ্রাফিকের দিকে সমঝদাররা ঝুঁকছেন। রংটাও স্থায়ী আর একাধিক প্রিন্ট হলেও মৌলিকতা থেকে বঞ্চিত হবার অবকাশ নেই। শিল্পে যান্ত্রিকতার আরেক ফসল হচ্ছে পপআর্ট। পাশ্চাত্যে এর ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। শিল্প কখনো মাধ্যম বা উপকরণ সর্বস্ব হওয়া উচিত নয়। যখন যা সুলভ তাই শিল্পের উপকরণ হতে পারে। আমি যখন প্রথম তাপিশ্রী করতে শুরু করি অনেকেই এর ভেতর পাশ্চাত্য রীতি আবিষ্কার করেছিলেন। অথচ উপকরণ, এর বুনন পদ্ধতিও—যেমন পট, চট পুরোপুরি আমাদের দেশীয়।
প্রশ্ন: পাশ্চাত্যের ইজমকে আপনি বলছেন বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ কি আপনি সমর্থন করেন?
রশিদ চৌধুরী: সামন্তবাদী এবং পুঁজিবাদী সমাজের সনাতন নিয়মগুলোকে ভাঙার জন্য যে বিদ্রোহ বর্তমান শিল্প তাকে গ্রহণ করে। তবে শিল্পের বিদ্রোহ নিজস্ব বিদ্রোহ। কখনো টেকনিক নিয়ে, কখনো বক্তব্য নিয়ে, বিদ্রোহ সমর্থন না করার পেছনে কোনো কারণ নেই। অনেক অসম্ভব শিল্পীরা প্রচলিত সকল মূল্যবোধকে প্রাপ্ত বলে, অনেক অসম্ভব নিরীক্ষা এই ইজমের মধ্যে হয়েছিল। দাদাইজমের শিল্পীরা প্রচলিত সকল মূল্যবোধকে ভ্রান্ত বলে তার বিপরীতে সেতার অনুসন্ধান করেছেন। দাদাইজমের এক ফরাসি কবির কবিতা আমি একসময় অনুবাদ করেছিলাম। ছোট ছড়ার মতো লেখা। কথাগুলো হচ্ছে, প্রাচ্যের দূর কোনো দেশ থেকে একজন জন হাটন একটা পেলিক্যান পাখি ধরে এনেছিল। পাখিটা তার পরদিন ডিম পাড়ল। ডিম ফুটে ঠিক সেই রকম আরেকটা পেলিক্যান বেরোল, নতুন পেলিক্যানটা পরদিন ডিম পাড়ল। কী আশ্চর্য, সেই ডিম থেকেও অবিকল আরেকটা পেলিক্যান বেরোল। সেই পেলিক্যানটা তার পরদিন আরেকটা পাড়ল। এক্ষুনি যদি এই ডিমটা অমলেট করে না খাও, তাহলে লক্ষ লক্ষ এক রকম পেলিক্যানে পৃথিবীটা ছেয়ে যাবে। বিদ্রোহের চরম বিকাশ ঘটেছিল দাদাইজমের যুগে। এরপর সুররিয়ালিজম এসেছে। অতি সম্প্রতি পপ আর্ট অপ আর্ট ইত্যাদি সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। পপ আর্টটা পুরোপুরি আমেরিকান। ইউরোপে এর প্রভাব ততখানি নয়। তবে অপ-আর্ট-এর প্রবল প্রতাপ ইউরোপে। অপ আর্ট যন্ত্র আশ্রয়ী চোখের মায়া, তা সত্ত্বেও পাশ্চাত্যের ভীষণ কর্মব্যস্ত জীবনে অপআর্ট-এর প্রয়োজন রয়েছে।
প্রশ্ন: আমাদের দেশে বিদ্রোহের ভঙ্গি নিয়ে কি কোনো শিল্প-আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে না?
রশিদ চৌধুরী: শিল্প আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব শিল্পীদের নয়। এ দায়িত্ব সমাজের, যে সমাজে শিল্পীরা বাস করেন। এটাও মনে রাখতে হবে, প্রদর্শনীর মাধ্যমে [যে] কোনো শিল্প আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব। শিল্পকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই শিল্প আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে।
প্রশ্ন: কীভাবে সেটা সম্ভব?
রশিদ চৌধুরী: শিল্পশিক্ষা সম্পর্কে আমাদের সমাজ দুঃখজনকভাবে উদাসীন। বাংলাদেশে এত দিন একখানা চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় ছিল, যেখানে শিল্প সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে চিত্রকলা পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই উপমহাদেশে এটা একটা ব্যতিক্রম। তবে প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়। যত দিন দেশের সকল স্কুলে চিত্রকলা আবশ্যিক পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হবে না, তত দিন দেশে কোনো শিল্প আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই।
বিচিত্রায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের ভূমিকা
শিল্পী রশিদ চৌধুরী বাংলাদেশের ব্যতিক্রম চিত্রকরদের একজন, যিনি আঙ্গিক ও রীতিতে ইউরোপীয় হয়েও বক্তব্য ও বিষয়বস্তুতে পুরোপুরি বাঙালি। যে কারণে তাঁর ছবি কখনো হারিয়ে যায় না। বৈশিষ্ট্যটুকু যেকোনো দর্শককে আকৃষ্ট করে। বিষয়বস্তু নির্বাচন করতে গিয়ে তিনি স্মৃতি ও কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে তাঁর সমাজ ও স্বদেশ এক আশ্চর্য অলৌকিক রূপে বিধৃত। বাংলার শাশ্বত রূপকে যেভাবে কবি জীবনানন্দ দাশ উপলব্ধি করেছেন তাঁর কবিতায়, রশিদ চৌধুরীর ছবিতে বারবার ঘুরেফিরে সেই বিশেষ রহস্যময় সৌন্দর্য ও রূপটি তাঁর সকল ঐতিহ্য উপকথা, জাদু লৌকিকতা ও মায়ামমতা নিয়ে ধরা পড়েছে। বাংলার প্রতি গভীর আনুগত্য রশিদ চৌধুরীর স্বকীয়তা।
শিল্পের প্রয়োজন ও শিল্পীর দায়িত্ব সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তাঁর বক্তব্য, কোনো শিল্পীর দায়িত্ব হচ্ছে তাঁর সমাজের প্রতি যেখানে তিনি জীবন ও সমাজকে সুন্দর করার দায়িত্ব পালন করবেন। শিল্প কোনো ব্যক্তিবিশেষের সম্পদ হওয়া উচিত নয়। শিল্প সকলের জন্য।
শিল্পের জগতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের চরম বিকাশ পাশ্চাত্যের যে সকল দেশে ঘটেছে, সেখানে শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও রশিদ চৌধুরী ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, ব্যক্তিকে নিয়ে ওরা বেশি মাতামাতি করে। কারণ বললেন, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অনিবার্যতা। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা মানুষকে গোষ্ঠী ও সময় থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। উদ্দেশ্য পুঁজির প্রসার। পিকাসো যত না ছবি এঁকেছেন, তাঁর ছবি সম্পর্কে বই বেরিয়েছে ঢের বেশি। কারণ, পিকাসো পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়েছেন। পিকাসোকে তাঁরা এমন এক স্তরে তুলে দিয়েছেন, যার কাছাকাছি অন্য কাউকে কল্পনা করার সুযোগ নেই। অথচ ইউরোপে তাঁর সমকক্ষ অনেক শিল্পী রয়েছেন; কেউ তাঁকে ছাড়িয়েও যেতে পারেন। তাঁদের নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়নি। তার কারণ, তাঁদের আঁকার সংখ্যা কম, অথচ পিকাসো পুঁজিবাদীর গ্যালারি সারা বছর ভরিয়ে দিতে পারেন।
প্রকাশকাল: ২৬ অক্টোবর, ১৯৭২, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১ম বর্ষ ২৪তম সংখ্যা
সমৃদ্ধ পাঠ। ধন্যবাদ সম্পাদক। শুভেচ্ছা শুভকামনা ।
চন্দন
নভেম্বর ০৩, ২০২১ ০২:১৭