
নতুন ভূখণ্ডের নতুন সাহিত্যিক ভাষা
উত্তর আমেরিকার জাতীয়তাবাদী কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান [১৮১৯-১৮৯২]-কে দুটো অবদানের জন্য স্মরণ করতেই হবে। প্রথমত, তিনিই সর্বপ্রথম কবিতায় মুক্তছন্দের ব্যবহার শুরু করেছিলেন এবং দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের মুখের স্ল্যাং বা অনানুষ্ঠানিক শব্দ তিনিই প্রথম সংগ্রহ করতে নেমেছিলেন আর সেসব শব্দের সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনার সূত্রপাতটিও করেছিলেন তিনিই। কবিতায় মুক্তছন্দ নিয়ে তিনি যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন, সেগুলোর উপস্থাপনা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এই প্রবন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ল্যাং বা অনানুষ্ঠানিক শব্দ নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার ওপরেই কেবল আলোকপাত করার চেষ্টা করা হবে।
স্মরণ করা যেতে পারে, আনুমানিক ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ সময় জুড়ে বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-দক্ষিণের বিভিন্ন রাজ্যের সাধারণ মানুষের জীবন ও পেশার সাথে জড়িয়ে থাকা বিস্তর লৌকিক শব্দ এবং বাগধারা সংগ্রহ করেছিলেন ওয়াল্ট হুইটম্যান। এই লৌকিক শব্দ এবং বাগধারাগুলো আমেরিকা মহাদেশের উত্তরাংশে আটলান্টিক-তীরবর্তী তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশ [১৬০৭-১৭৮৩] এবং তারপরে গঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামের বিশাল একটি নতুন দেশের এলিটদের দৈনন্দিন মুখের কথা অথবা ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যে রচিত তাদের আধুনিক ইংলিশ সাহিত্যে কখনোই ঠাঁই পায়নি। নোয়া ওয়েবস্টারের আমেরিকান ইংলিশ অভিধান [১৮২৮]-এও অচ্ছুত থেকে গেছে এসব নতুন নতুন সব শব্দ এবং বাগধারা। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি [১৮৫৭]-তে এদের জায়গা পাবার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না! তবে বাস্তবতা এই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামের সুবিশাল ভূখণ্ডের বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের ভেতরে বিভিন্ন পারস্পরিক লেনদেনের মাধ্যমেই তৈরি হয়েছিল এসব লৌকিক শব্দ ও বাগধারা। এই সৃজনের ক্রীড়নকদের মধ্যে তো আমেরিকা মহাদেশের আদিবাসীরা ছিলই, আরও ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সাধারণ অভিবাসী এবং আফ্রিকা থেকে বলপূর্বক স্থানান্তরিত মানুষজন। আমরা জানি, ১৪৯২ থেকে ১৮২০ সালের ভেতরে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ এবং পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক-তীরবর্তী এলাকায় গিয়ে জুড়ে বসেছিল মুখ্যত ইংলিশ, আইরিশ, স্কটিশ, জার্মান ও ফরাসিরা। হুইটম্যান যখন ভাষা ও শব্দতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন, তখনো দক্ষিণ ইতালি ও সিচিলিয়া থেকে মার্কিন মুল্লুকে ইতালীয়দের অভিবাসন শুরু হয়নি। মার্কিন মুল্লুকে ইতালীয়দের অভিবাসনের সময় ১৮৮০ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত। এ ছাড়া, ১৫২১ সালে গঠিত মেক্সিকো সিটি নির্ভর নয়া স্পেইন-এর অভিবাসীরা ছেয়ে পড়েছিল প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলের ক্যালিফোর্নিয়া এবং মেক্সিকোর উত্তরের অ্যারিজোনা, নিউ মেক্সিকো ও টেক্সাসের বিস্তীর্ণ এলাকাতে। আফ্রিকা থেকে জোরজবরদস্তি করে আমেরিকাতে ধরে আনা হাজার হাজার দাসের কথাও এখানে না বললেই নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের সময় থেকে, অর্থাৎ ১৭৭৬ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল দাস ব্যবসা, বিশেষত, দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে। ক্রমান্বয়ে দেখা গেল, আমেরিকা মহাদেশের উত্তরাংশের যে এলাকাগুলোর কথা হচ্ছে, সেখানে বসবাসরত এক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ আরেক জাতিগোষ্ঠীর মানুষের কাছ থেকে অথবা এক ভৌগোলিক এলাকার মানুষ আরেক ভৌগোলিক এলাকার মানুষের কাছ থেকে সুবিধাজনক মৌখিক শব্দ গ্রহণ করছে। যেমন, আদিবাসী শায়ান বা আরাপাহো কিংবা চেরোকি গোত্রের লৌকিক শব্দ ধার করছে ইংলিশরা; ইংলিশ বা আইরিশরা লৌকিক শব্দ নিচ্ছে ফরাসি বা স্প্যানিশ ভাষাভাষীদের কাছ থেকে; আবার উত্তরের ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের মানুষজন আত্তীকরণ করছে দক্ষিণের টেনেসির মানুষদের লৌকিক শব্দ। আমেরিকার এই ‘মহামানবের সাগরতীরে’ এভাবে ভাষা ও সংস্কৃতির দেওয়া-নেওয়া এবং মেলানোর খেলা চলেছে। এই দেওয়া-নেওয়ার প্রক্রিয়াতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের তৎকালীন ইংলিশ ভাষার কিছু কিছু শব্দের দ্যোতনা পরিবর্তিত হয়ে যেতেও আমরা দেখছি। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দেখা গেল, ভাষার রূপ বদলে যাবার গতিশীল প্রক্রিয়াতে এসব নতুন আর পুরাতন বিভিন্ন শব্দ জড়াজড়ি করতে করতে তৎকালীন ইংলিশ ভাষায় গড়ে উঠছে নতুন নতুন সব বাগধারা। মিথস্ক্রিয়ার প্রক্রিয়াতে নির্ধারিত হয়ে যাওয়া নতুন এসব শব্দ এবং বাগধারা পরাক্রমশালী ইংলিশ শব্দ এবং বাগধারার পাশেই টিকে থেকেছে মানুষের মুখে মুখে, বেগবান হয়েছে ক্রমশ। কুলীনদের চোখের আড়ালে রয়ে যাওয়া এসব শব্দ এবং বাগধারাগুলোকে ইংলিশ ভাষার সম্পদ হিসেবেই বিবেচনা করেছেন ওয়াল্ট হুইটম্যান। আমরা জানি, এভাবেই কালক্রমে আমেরিকা মহাদেশে তৈরি হয়েছিল আমেরিকান ইংলিশ নামের নতুন একটি বিবর্তিত ইংলিশ ভাষা। খোদ ইংল্যান্ড থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বয়ে নিয়ে যাওয়া ইংলিশ ভাষার বিবর্তনের এমন প্রক্রিয়াতে আসলে মূল ভূমিকা রেখেছিল জাতি-বর্ণনির্বিশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সাধারণ মানুষেরাই। সাধারণ মানুষের মুখে মুখে গড়ে ওঠা সেই বিশাল লৌকিক শব্দভাণ্ডারকে স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক উপকূলের ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকেরা তাদের উচ্চম্মন্যতাবোধ থেকে পায়ে ঠেলেই রেখেছিল—তাদের দৈনন্দিন মুখের ভাষায় তা তারা ব্যবহার করেনি আর তাদের প্রচলিত আধুনিক ইংলিশ ভাষার সাহিত্যে তা ব্যবহার করাকে তো তারা সহি মনেই করেনি কোনো দিন! আমেরিকা মহাদেশে ঘটে যাওয়া ভাষা-সংস্কৃতির এই রাজনীতি সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। সেই রাজনীতিতে ওয়াল্ট হুইটম্যান নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে বিবর্তিত হতে হতে উনিশ শতকের ইংলিশ ভাষায় ঢুকে থাকা নতুন কিছু লৌকিক শব্দ সংগ্রহ করেছিলেন ওয়াল্ট হুইটম্যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত প্রায় আঠারো শ নতুন লৌকিক শব্দের এই তালিকার তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘নেইমস অ্যান্ড স্ল্যাং ইন আমেরিকা’। এই তালিকা অবশ্য সেই মুহূর্তে প্রকাশিত হয়নি। তৎকালীন আধুনিক ইংলিশ ভাষার কাঠামোতে ইংলিশ শব্দের পাশাপাশি সংগৃহীত নতুন নতুন এসব লৌকিক শব্দ এবং বাগধারা ব্যবহার করে তিনি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লিভস্ অব গ্রাস’ প্রকাশ করেন ১৮৫৫ সালে [অবশ্য তাঁর জীবদ্দশায় এই কাব্যগ্রন্থের মোট ছটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়]। ‘লিভস্ অব গ্রাস’-এর মুখবন্ধে তিনি তাঁর কবিতার পেছনের তত্ত্ব এবং কবিতাগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়া লৌকিক শব্দ ব্যবহার করার পেছনে যুক্তিও তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া এই সময়টিতে তিনি নতুন ভূখণ্ডের ভাষা ও শব্দতত্ত্ব নিয়ে মোট তিনটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর প্রথম প্রবন্ধ ‘আমেরিকাস্ মাইটি ইনহেরিটেন্স’ ১৮৫৬-তে প্রকাশিত হয় ‘লাইফ ইলাস্ট্রেটেড’ নামের একটি অখ্যাত ম্যাগাজিনে। ‘নর্থ আমেরিকান রিভিউ’-এর অনুরোধে তিনি ‘স্ল্যাং ইন আমেরিকা’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন, যা পত্রিকাটিতে ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর মৃত্যুর পরে ‘দ্যা আটলান্টিক’-এর এপ্রিল ১৯০৪ সংখ্যায় ছাপা হয় ‘এন আমেরিকান প্রাইমার’ নামে তাঁর তৃতীয় প্রবন্ধ। এ ছাড়া তিনি বেনামেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাষা ও শব্দতত্ত্ববিষয়ক একটি বই রচনা করেন। বইটার নাম—‘রাম্বেলস্ অ্যামাং ওয়ার্ডস্’ [১৮৫৯]। বইটি ছাপা হয়েছিল তাঁর লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষক-বন্ধু উইলিয়াম স্যুইন্টন-এর নামে। এসব প্রবন্ধ এবং একটি বই বাদে বহু ভাষাভাষী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্ল্যাং সংবলিত ‘ওয়ার্ডস্’ নামে তাঁর একটি অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিরও সন্ধান পাই আমরা। উপর্যুক্ত কাজগুলোতে ওয়াল্ট হুইটম্যান আমেরিকান ইংলিশ ভাষায় নব্য লৌকিক শব্দের গতিময় প্রকৃতি এবং তার জরুরি অবদান নিয়ে যা বলতে চেয়েছেন, তা একটু দেখে নেওয়া যাক।
‘লিভস্ অব গ্রাস’ [১৮৫৫]-এর মুখবন্ধে ওয়াল্ট হুইটম্যান বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদের অভিযাত্রার পেছনে সবচেয়ে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখছে সেখানকার সাধারণ মানুষ—দেশটির নীতিনির্ধারক বা আইনপ্রণেতা কিংবা কোনো আমলা অথবা চার্চ বা লেখকগোষ্ঠী কিংবা সংবাদপত্রকর্মীরা কেউই নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদ গঠনের প্রক্রিয়ার অংশীদার এসব সাধারণ মানুষের কথাই লিখতে হবে সেখানকার একজন কবিকে; তুলে ধরতে হবে আমজনতার গর্বের এই দিক। কবিদের সেই মহাকাব্যের সাহিত্যিক ভাষাটি তবে কেমন হবে? হুইটম্যান মনে করেছেন, সাধারণ মানুষদের মুখের ভাষাতেই সেই প্রকাশ ঘটাতে হবে—এলিটদের প্রথাগত অভিধাননির্ভর ভাষাতে নয়। সে জন্য একজন আমেরিকান কবির উচিত হবে ভূখণ্ডটির বহু-জাতিগোষ্ঠী-বহু-ভাষার প্যান-আমেরিকান বাস্তবতার দিকটি তুলে ধরা। ‘লিভস্ অব গ্রাস’ [১৮৫৫]-এর মুখবন্ধতেই কেবল নয়—কাব্যগ্রন্থটির মোট বারোটি মুক্তছন্দের কবিতায় তিনি বারবার বলেছেন এই কথাগুলোই। ‘সং অব মাইসেল্ফ’, ‘আ সং ফর অকিউপেশনস্’, ‘দ্যা স্লিপার্স’, ‘ফেইসেস্’, ‘আ বস্টন ব্যালাড’ ইত্যাদি দীর্ঘ কবিতা হুইটম্যানের বর্ণনাতে সেই বাস্তবতা ছড়িয়ে আছে আটলান্টিক মহাসাগর থেকে পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর এবং কানাডার সীমান্ত থেকে মেক্সিকোর সীমান্ত অবধি উত্তর-দক্ষিণের বিভিন্ন রাজ্যের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অঙ্গনে; আদিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতির লালিত্যে, রূঢ়তায়; নগর গড়ে ওঠার রক্তে আর ঘামে; কয়লাখনির দেয়ালে দেয়ালে জমে থাকা আর্তরেখায়; বিভিন্ন পেশার মানুষের টিকে থাকবার সংগ্রামে; রক্তাক্ত দাসপ্রথায়; ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিভিন্ন যুদ্ধে, শান্তির পর্যায়ে এবং অখণ্ড দেশ তৈরির প্রক্রিয়া প্রভৃতিতে। তাই অ্যাংলো-স্যাক্সনদের রোমান্টিক ধারায় এবং তাদের বেঁধে দেওয়া সাহিত্যিক ভাষাতে কবিতা লেখা কিছুতেই উনিশ শতকের আমেরিকার নতুন যুগের একজন কবির একমাত্র মোক্ষ হতে পারে না বলেই হুইটম্যান মনে করেছেন। এ কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়া লৌকিক ভাষাতে হুইটম্যান নতুন ধরনের কবিতা লেখার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আধুনিক কবিতার নয়া একটি ধারার সূচনা করেছিল বলে আমরা জানি।
‘লিভস্ অব গ্রাস’-এর মুখবন্ধের ধারাবাহিকতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাষা ও শব্দতত্ত্ব নিয়ে ১৮৫৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ওয়াল্ট হুইটম্যানের প্রথম প্রবন্ধ ‘আমেরিকাস্ মাইটি ইনহেরিটেন্স’। এ প্রবন্ধে সেই সময়কার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত ইংলিশ ভাষা নিয়ে তাঁর সবিশেষ প্রশস্তিই প্রকাশ পেয়েছিল। এটি আমরা সবাই জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক উপকূলের উপনিবেশগুলোতে ইংলিশ অভিবাসীর সংখ্যাই ছিল সবচেয়ে বেশি, তারপরেই ছিল যথাক্রমে আইরিশ এবং স্কটিশদের অবস্থান। জার্মান আর ফরাসিদের অবস্থান ছিল আরও পরে। কাজেই মানতেই হবে যে, ব্রিটিশদের হাতে পত্তন করা উপনিবেশগুলোতে মৌখিক ও লিখিত ভাষা হিসেবে সহজেই প্রাধান্য বিস্তার করেছিল ইংল্যান্ড থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া এই ইংলিশ ভাষা। আর তা ছাড়া পরে আটলান্টিক উপকূলে ব্রিটিশ শাসনের পরিপ্রেক্ষিতে এই আধুনিক ইংলিশ ভাষাই আনুষ্ঠানিক ভাষাতে রূপ নিয়েছিল, যে-ভাষা তুলনামূলকভাবে সংখ্যায় কম জার্মান আর ফরাসিদেরকেও রাজভাষা এবং ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করতে হয়েছে। হুইটম্যান বলছেন, আমেরিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো এই ইংলিশ ভাষা। কেননা এ ভাষা জড়ভরত হয়ে পড়ে থাকেনি—বহু ভাষাভাষী মানুষেরা এই ভাষাকে বরং নতুন করে সৃজন করে নিয়েছে—মূল ইংলিশ ভাষাতে তারা সংযোজন করেছে নিত্যনতুন শব্দ এবং প্রচলিত বিস্তর ইংলিশ শব্দের দ্যোতনাও এভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। অ্যাংলো-স্যাক্সন ঔপনিবেশিকদের বিবর্তনমুখর ইংলিশ ভাষার এই ঐতিহাসিক বাস্তবতাই আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে দিয়েছে নতুন একটি পরিচয়। বহুত্ববাদের ভেতরে সেখানকার অধিবাসীদের ভাষাবিষয়ক ঐক্যের কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হুইটম্যান ‘সবচেয়ে সুন্দর একটি কাব্য’ হিসেবে অভিধা দিয়েছেন।
ওয়াল্ট হুইটম্যান ১৮৮৫ সালে ‘নর্থ আমেরিকান রিভিউ’-তে লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘স্ল্যাং ইন আমেরিকা’। ‘স্ল্যাং ইন আমেরিকা’-তে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণমানুষের মুখের শব্দ ও বাগধারার ওপরে ভিত্তি করে নতুন একটি লৌকিক ভাষার জন্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। আনুষ্ঠানিক সাহিত্যে গণমানুষের মুখের ভাষার গুরুত্ব এবং তার প্রয়োগের ওপরে ইতালির মহাকবি দান্তে আলিঘেইরির লেখা ‘অন দ্য ভালগার টাং’ [‘ডি ভালগারি এলোকোয়েন্তা’] শীর্ষক প্রবন্ধের পরে সাহিত্যের ভাষাবিষয়ক এমন গভীর পর্যবেক্ষণ আমরা একমাত্র হুইটম্যানের কাজেই লক্ষ করি। দান্তে ১৩০২ থেকে ১৩০৫-এ তাঁর এই সাড়া জাগানো প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। ‘স্ল্যাং ইন আমেরিকা’-তে আমরা হুইটম্যানকে স্ল্যাং বা অনানুষ্ঠানিক শব্দের একটি সংজ্ঞা নির্ণয়ে তৎপর হতে দেখছি। তাঁর মতে, স্ল্যাং হলো ব্যাকরণকে কাঁচকলা দেখিয়ে তৈরি হয়ে যাওয়া অঙ্কুর, যা প্রথাগত আভিধানিক সব শব্দ আর বাগধারার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। দীর্ঘকাল ধরে এই শব্দাঙ্কুর ভাষাবিদদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মানুষের ভাবপ্রকাশের বাচনের ভেতরে বেড়ে ওঠে। মানুষের বাচনে অন্তহীনভাবে সক্রিয় এসব শব্দাঙ্কুরের গায়ে জমে থাকা ফেনা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা বিবর্তনের ধাপে ধাপে একসময়ে ঝরে পড়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত এসব অঙ্কুর দীর্ঘ মেয়াদে স্থায়ী শব্দে রূপান্তরিত হয়। শব্দগুলোর কিছু হয়তো কালে কালে বৈয়াকরণদের হাতে তৈরি করা অভিধান নামের আনুষ্ঠানিকতায় জায়গা পেয়ে যায়, কিছু হয়তো তা পায় না। কিন্তু লৌকিক ব্যবহারের ভেতরে হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকে এসব লৌকিক শব্দ এবং বাগধারা।
‘স্ল্যাং ইন আমেরিকা’-তে ওয়াল্ট হুইটম্যানের পর্যবেক্ষণ বলছে, মানুষের মুখে মুখে বিবর্তিত হতে হতে এভাবেই গড়ে উঠেছে আমাদের চেনাপরিচিত আভিধানিক সব শব্দ; দাপ্তরিক কাজে, হাটেবাজারের লেনদেন প্রক্রিয়া ও সাহিত্যে ব্যবহৃতও হচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে। তিনি মন্তব্য করছেন, একটি ভাষা কখনোই কোনো বিদ্বান ভাষাবিদ বা অভিধানপ্রণেতাদের হাতে তৈরি হয় না—ভাষা তৈরি হয় সাধারণ মানুষের নতুন নতুন শব্দের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই। এই সেই লৌকিক ভাষা যেই ভাষাতে সাধারণ মানুষ তাদের আনন্দ, বেদনা, দুঃখ, ভালোবাসা, বন্ধন, রুচি ইত্যাদির প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। এভাবেই মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষের প্রাণের শব্দকে ধারণ করে একটি ভাষা। আনুমানিক ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ সালের ভেতরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ঘুরে এই সুবিশাল শব্দভাণ্ডারেরই কিছু শব্দ [নামশব্দ, বিশেষণ ও ক্রিয়াপদ] ও বাগধারা সংগ্রহ করবার চেষ্টা করেছিলেন হুইটম্যান। মানুষের ডাকনাম, বিভিন্ন রাজ্য বা গ্রাম কিংবা শহরের নাম অথবা পেশার নামের সাথে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক নামশব্দের খোঁজ পেয়েছিলেন তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপ থেকে ভেসে আসা নানা অভিবাসীর মুখে তৈরি হওয়া অনানুষ্ঠানিক নামশব্দ ছাড়াও তিনি সেখানকার লৌকিক ভাষাতে আদিবাসী ইন্ডিয়ান এবং আফ্রিকা থেকে ধরে নিয়ে আসা দাসদের বিভিন্ন শব্দের উপস্থিতিও লক্ষ করেছিলেন। উত্তর আমেরিকায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকেরা ইংল্যান্ডে গড়ে ওঠা যে আধুনিক অ্যাংলো-স্যাক্সন ভাষা আনুষ্ঠানিকভাবে চাপিয়ে দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীন অভিবাসী, আদিবাসী এবং দাসদের ওপর, সেখানে এসব নতুন নতুন নামশব্দ, বিশেষণ বা ক্রিয়াপদের কোনো স্থানই ছিল না তখন। এরপরে হুইটম্যন বলছেন যে, এসব স্ল্যাং বা অনানুষ্ঠানিক শব্দই ভাষার বিবর্তনে মূল ভূমিকা রেখে থাকে। ভাষার বিবর্তনের গতিশীল এই প্রক্রিয়াতে লুকিয়ে থাকে অজস্র ধাপ, যেগুলোকে কালের নিরিখে সাদাচোখে চিহ্নিত করাটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কাজেই, মানতেই হবে, আদতেই ভাষা একটি জীবন্ত প্রক্রিয়া, যাতে পয়লাতে ইন্ধন জোগায় গণমানুষের মুখে মুখে জন্ম নেওয়া লৌকিক সব শব্দ। গতিময়তার কারণে এভাবে একটি ভাষা বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসকে ধারণ করে থাকে। আমরা জানি, এই ধরনের বৈচিত্র্যময়তাই জগতের সব গতিশীল চলকের অন্তর্নিহিত নিয়ম। একটি ভাষার বিবর্তনও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়।
ওয়াল্ট হুইটম্যানের মৃত্যুর পরে ‘দ্য আটলান্টিক’-এর এপ্রিল ১৯০৪ সংখ্যায় ‘অ্যান আমেরিকান প্রাইমার’ নামে যে প্রবন্ধটি ছাপা হয়, সেটাতেও ধ্বনিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাষার বিবর্তনবিষয়ক একই সুর। ব্যবহারিক দিক থেকে লৌকিক ভাষানির্ভর এই নয়া আমেরিকান ইংলিশ ভাষার প্রকৃতির সাথে অ্যাংলো-স্যাক্সনদের হাতে সূচিত আধুনিক ইংলিশ ভাষার প্রকৃতির দুস্তর পার্থক্য রয়েছে বলেই হুইটম্যান প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং পরে ভাষাবিদেরা এ ব্যাপারে একমতও হয়েছেন বলে আমরা জানি। ‘অ্যান আমেরিকান প্রাইমার’-এ হুইটম্যান আমাদেরকে জানাচ্ছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহু ভাষাভাষী মানুষের মিথস্ক্রিয়া ঘটেছে মূলত সেখানকার সেলুনগুলোতেই। পানাহার, চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া, দেহোপজীবী নারীদের সাথে খোশগল্প আর মাস্তি করা—এসব প্রাত্যহিক কাজের সূত্রেই সেলুনগুলোতে বহু ভাষাভাষী মানুষের ভেতরে সম্মিলন ঘটেছে, অচেতনভাবেই পরস্পরের ভেতরে আদান-প্রদান হয়েছে যার যার নিজস্ব শব্দের। হুইটম্যান বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহু ভাষাভাষী মানুষ দুটি জরুরি কাজ করেছে—প্রথমত, তারা প্রচলিত ইংলিশ ভাষার শব্দভাণ্ডারে সংযোজন করেছে হাজার হাজার শব্দ, এবং দ্বিতীয়ত, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা মূল ইংলিশ ভাষার শব্দের দ্যোতনাও বদল করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি অনেক স্ল্যাং শব্দ এবং বিভিন্ন রাজ্যের বা এলাকার নামের উদাহরণ দিয়েছেন যেগুলো কস্মিনকালেও মূল ইংলিশ ভাষার কোনো অভিধানে খুঁজেও মিলবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণমানুষের মুখের যেসব স্ল্যাং বা অনানুষ্ঠানিক শব্দ এবং বাগধারা সংগ্রহ করেছিলেন ওয়াল্ট হুইটম্যান তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লিভস্ অব গ্রাস’ [১৮৫৫]-এ তিনি সেই ভাণ্ডার থেকে বিস্তর শব্দ ব্যবহার করেছেন বলেই আমরা দেখছি। কাব্যগ্রন্থটির প্রথম সংস্করণের প্রথম কবিতা ‘সং অব মাইসেল্ফ’-এ আমরা খুঁজে পেয়েছি অর্ধশতাধিক বিচিত্র লৌকিক শব্দ [নামশব্দ, বিশেষণ ও ক্রিয়াপদ] এবং বাগধারা। এখানে তার কটি উদাহরণ সংযোজনের চেষ্টা করা হলো—
Loafe: সামনে এগিয়ে যাওয়া
Halfbreed straps: মিশ্র জাতের মানুষ
Deck-hand: উচ্চাভিলাষী
Skein: সুতোর রিলের বাইরে ঝুলতে থাকা সুতোর প্রান্ত
Yankee: আমেরিকার উত্তরাংশের বিভিন্ন রাজ্যের মানুষজন
Wolverine: মিশিগান রাজ্যের অধিবাসীরা
Huron: লেক হিউরন এলাকার ইন্ডিয়ান গোত্রের সদস্য
Talker: যে কথা বলছে
Tripper: দৃষ্টিভ্রম
Asker: যেকোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছে
Paving-man: যে মানুষ পথের মাঝে অন্যকে তার আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে উত্যক্ত করে
Regatta: যে নারী তার যোনিতে ড্রাগ লুকিয়ে রেখে চলাফেরা করে
Drover: চূড়ান্ত বদমাশ
Opium-eater: জঘন্যতম মানুষ
Bob: কেটে দৈর্ঘ্য কমিয়ে ফেলা চুল
Tipsy: সামান্য মাত্রার মাতলামি
Flatboatman: একঘেয়ে মানুষ
Coon-seeker: যেসব আফ্রিকান-আমেরিকান মানুষ এখনো নিজেদেরকে তাদের অতীতেই বন্দি করে রেখেছে
Stander: যে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে
Unscrew: যখন কোনো পুরুষ কোনো নারীর যোনি থেকে বীর্য চেটেপুটে খায়
Dumb: বোকার হদ্দ
The father-stuff: বাপের পকেটের টাকাপয়সা
Dud: যে বোমের শেল এখনো ফাটেনি
Egress: আগুন ধরে গেলে নিরাপদে পালিয়ে যাবার পথ
Waded: যে সাদামানুষের ভেতরে কালো গাত্রবর্ণের মানুষের কোনো বৈশিষ্ট্য ঢুকে গেছে। যেমন, পুরুষের অতিদীর্ঘকার পুরুষাঙ্গ
Swoop: কাউকে যাবার পথে গাড়িতে তুলে নেওয়া
Gab: খামোখা বকবক করা
Yawp: উঁচু স্বরে অভিযোগ জানানো
Scud: অনাকর্ষণীয় নারী
Wild: অযৌক্তিকতা
Coaxe: মৃদু প্ররোচনা প্রদান করা
Eddie: নারীর মনভোলানো পুরুষ
Jag: বোকা বা অযোগ্য মানুষ
Sluff: স্কুল পালানো কোনো ছাত্র বা ছাত্রী
Spotted with gore: শরীরে বসে যাওয়া কারও শারীরিক হিংস্রতার চিহ্ন
এখানে কেবল হুইটম্যানের কাব্যগ্রন্থ ‘লিভস্ অব গ্রাস’ [১৮৫৫]-এর ‘সং অব মাইসেল্ফ’ নামের কবিতায় ব্যবহৃত স্ল্যাং বা অনানুষ্ঠানিক শব্দের মোটামুটি একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। কাব্যগ্রন্থটির বাকি এগারোটা কবিতা খুঁজলে এমন আরও অসংখ্য অনানুষ্ঠানিক শব্দের উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। ভিক্টোরীয় ইংলিশের কাঠামো এবং প্রচলিত শব্দের ফাঁকে ফাঁকে হুইটম্যান তাঁর নিজের সংগৃহীত নানা অনানুষ্ঠানিক শব্দ ‘লিভস্ অব গ্রাস’-এর কবিতাগুলোতে এভাবেই গুঁজে দিয়েছেন।
এবার প্রশ্ন এসে পড়ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে ঘুরে ওয়াল্ট হুইটম্যান কেন আদিবাসী, বসতি স্থাপনকারী এবং দাসদের কাছ থেকে নতুন নতুন সব অনানুষ্ঠানিক শব্দ সংগ্রহ করতে গেলেন! কেউ কেউ বলছেন, এ অভিযানে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু উইলিয়াম স্যুইনটন। এই সেই উইলিয়াম স্যুইনটন, যাঁর গোস্ট রাইটার হিসেবে হুইটম্যান ‘রাম্বেলস্ অ্যামাং ওয়ার্ডস্’ [১৮৫৯] নামের বই লিখেছিলেন! স্যুইনটন তাঁকে আদৌ প্রভাবিত করেছিলেন কি না সে বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়ে গেছে অবশ্য। তবে আমরা ধরে নিতেই পারি, নতুন নতুন শব্দের যেসব অভিধান ইংল্যান্ডে প্রকাশিত হয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো হুইটম্যানের গোচরে না এসে যায়ই না! আমরা জানি, ১৭ ও ১৮ শতকের ইংল্যান্ডে বেশ কটি ইংলিশ স্ল্যাং ডিকশনারি বের হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে রিচার্ড হিড-এর ‘ডেভিলস্ ক্যাবিনেট ওপনেড’ [১৬৭৩] এবং ফ্রান্সিস গ্রোস-এর ‘আ ক্ল্যাসিক্যাল ডিকশনারি অব দ্য ভালগার টাং’ [১৭৮৫]-এর কথা আনা যেতে পারে। ইংল্যান্ডের স্ল্যাংয়ের এসব অভিধান ওয়াল্ট হুইটম্যানের নজরে আসাটা বিচিত্র কিছু নয়, যা হয়তোবা তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন লৌকিক শব্দ সংগ্রহ করার নেশায় ঠেলে দিয়েছিল। গোপন ভাণ্ডার থেকে লৌকিক শব্দ খুঁজে খুঁজে বের করবার এই নেশার কথা বারবার স্বীকার করে গেছেন হুইটম্যান স্বয়ং। নিজের ঔৎসুক্য থেকেই ওয়াল্ট হুইটম্যান এ দুরূহ কাজটি করেছিলেন বলে আমরা ধারণা করি।
দ্বিতীয় প্রশ্ন যেটা উঠছে—নিজের ঔৎসুক্য থেকে লৌকিক শব্দ এবং বাগধারা তুলে আনার কাজ করলেও তার মানে এই নয় যে, সেই সব শব্দ এবং বাগধারা কবিতা লেখার সময় ওয়াল্ট হুইটম্যানকে ব্যবহার করতেই হবে! তবে তিনি তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘লিভস্ অব গ্রাস’ [১৮৫৫]-এ কেন আমেরিকার গণমানুষের মুখের ভাষায় কবিতা রচনা করতে গেলেন? এ বিষয়ে আমরা স্মরণ করতে চাই, খোদ ইংল্যান্ডে জেফ্রি চসার [১৩৪৩-১৪০০]-এর দেখানো পথ ধরে গণমানুষের মুখের ভাষাতে সাহিত্য করবার প্রবণতা শুরু হয়েছিল। আমরা অনুমান করি, ইংলিশ কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার [১৫৬৪-১৬১৬]-ও চসারের পদচিহ্ন অনুসরণ করেছিলেন। আমরা দেখছি, শেক্সপিয়ার যখন লন্ডনে বিভিন্ন নাটকের মঞ্চায়ন করছেন, তখন তিনি রাস্তার পাশের ছোটখাটো বইয়ের দোকান এবং বইয়ের ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে নিয়মিতভাবে সমসাময়িক নানা দলিল-দস্তাবেজ কিনছেন। সেগুলোর ভেতরে রয়েছে গান ও গীতিকাব্যগাথা, বুকলেট, প্যামফ্লেট, আদালতের কার্যবিবরণী, ধর্মোপদেশ, পঞ্জিকা, কৃষি-ম্যানুয়াল, ভাঁড়ামি আর কৌতুকের বই, ব্যঙ্গকথা, বীরত্বগাথা ইত্যাদি। এসব দলিল থেকে তিনি নানা ঘটনা ছাড়াও বিবিধ লৌকিক শব্দ সংগ্রহ করেছেন এবং তিনি তাঁর নাটকে সাধারণ মানুষের বয়ানে ঢুকিয়ে দিয়েছেন সেগুলোকে। শেক্সপিয়ারের নাটকের ছুতোর মিস্ত্রি, মুচি, খুনি, গৃহভৃত্য, ঠ্যালাওয়ালা, গাঁওগেরামের মানুষ—এরা সবাই গণমানুষের মুখের ভাষাতেই কথা বলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান তাঁর এই পূর্ববর্তী ইংলিশ কবি ও নাট্যকারের কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকতেই পারেন। এ বিষয়ে অবশ্য এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা চোখে পড়ছে না। আমরা কেবল জানি, নিউইয়র্ক সিটিতে বসবাস করার সময় হুইটম্যান নিয়মিতভাবে থিয়েটারে যেতেন। সেখানে তিনি শেক্সপিয়ারের নাটকও দেখেছিলেন এবং তিনি শেক্সপিয়ারের কাজের মস্ত বড় ভক্তই ছিলেন বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে শেক্সপিয়ার তাঁর নাটকে কেন গণমানুষকে নায়ক বানাননি, তা নিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন হুইটম্যান।
ওয়াল্ট হুইটম্যানের কৃতিত্বটি এখানেই যে, তিনি বহু জাতি, বহু ভাষাভাষী মানুষের সম্মিলনের ভূখণ্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গতিময় বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সে কারণেই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গজিয়ে ওঠা নতুন নতুন স্ল্যাং বা অনানুষ্ঠানিক শব্দ ও বাগধারা সংগ্রহকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং তিনি তা অ্যাংলো-স্যাক্সনদের ইংলিশ সাহিত্যে প্রয়োগ করেও দেখিয়েছিলেন। আমরা জানি, হুইটম্যানের মৃত্যুর পরে তাঁর স্বদেশি কবি টি. এস. এলিয়ট [১৮৮৮-১৯৬৫] তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক-এ ব্যবহার করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক উপকূলের পূর্ব তীরের বাসিন্দাদের মুখের ভাষা, যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন স্থানিক শব্দ, শব্দগুচ্ছ, বাগধারা ইত্যাদি। এলিয়টের এই কবিতার মাধ্যমে রোমান্টিক যুগের পরে সাহিত্যে আধুনিক যুগের সূচনা ঘটেছিল বলে আমরা জানি। তবে এলিয়টের কাজের ওপরে হুইটম্যানের স্থানিক ভাষারীতির কোনো প্রভাব পড়েছিল বলে জানা যায় না। এলিয়টও এ ব্যাপারে কোনো কিছু ভেঙে বলেননি।
পরিশেষে আমরা বলব, ওয়াল্ট হুইটম্যানের ভাষা ও শব্দতাত্ত্বিক কাজের প্রভাব তাঁর সমসাময়িক বা পরবর্তী লেখকদের ওপরে না পড়লেও নিঃসন্দেহে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাবিদ ও শব্দতাত্ত্বিকদের উসকে দিয়েছিল। সে কারণেই হয়তো হুইটম্যানের মৃত্যুর অনেক পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু স্ল্যাং ডিকশনারি প্রকাশিত হয়েছিল, যার ভেতরে ‘চ্যাপম্যান ডিকশনারি’ [১৯৬০] এবং ‘রেন্ডম হাউস ডিকশনারি’ [১৯৯৪ এবং ১৯৯৭ এডিশন] অন্যতম। ‘লিভস্ অব গ্রাস’ [১৮৫৫]-এর ‘সং অব মাইসেল্ফ’ নামের কবিতায় হুইটম্যান যেসব অনানুষ্ঠানিক শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, সেগুলোর কিছু কিছু আমরা র্যান্ডম হাউস ডিকশনারিতে খুঁজে পেয়েছি। ♦